তিতাসে লাগামহীন সিস্টেম লসের নামে গ্যাস চুরি

হরলাল রায় সাগর
১৩ জুন, ২০২২, 1:08 AM

তিতাসে লাগামহীন সিস্টেম লসের নামে গ্যাস চুরি
বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লসের নামে গ্যাস চুরি থামছে না কোনভাবেই। এই সিস্টেমে মাসে চুরি হচ্ছে প্রায় ৬ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস, যার দাম আমদানি মূল্যে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং বিতরণ কোম্পানিগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র। মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিতরণ কোম্পানিগুলোর একশ্রেনীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেট ভারী হচ্ছে এই টাকায় বলে অভিযোগ বহু পুরানো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুরির পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ কমানো গেলেও স্পট মার্কেট তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে হত না। আর স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস আমদানি করতে না হলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। মুনাফায় থাকা গ্যাসের ৬টি বিতরণ কোম্পানি দাম না বাড়িয়ে বিদ্যমান বিতরণ চার্জ (প্রতি ঘনমিটার ২৫ পয়সা) বাতিল করলেও চলে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন খোদ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)-এর করিগরি কমিটি। আর এতে ভোক্তাদেরও বাড়তি বিলের বোঝা বহন করতে হত না।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে নানা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির ২২টি উৎস চিহ্নিত করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। এসব দুর্নীতি বন্ধে ২০১৯ সালের এপ্রিলে ১২ দফা সুপারিশও করা হয়। কিন্তু সেই সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়নি আর লুটপাটও বন্ধ হয়নি।
কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম সম্প্রতি গ্যাসের দাম বাড়ানোর গণশুনানীকালে বলেছিলেন, ‘আমরা মনে করি চুরি ঠেকানো গেলে স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। তখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর বদলে কমানো যাবে। আমরা হিসেব করে দেখিয়ে দিয়েছি গ্যাসের দাম প্রতি ঘনফুট ১৬ পয়সা কমানো যায়।’
কিন্তু কয়েকদিন পরেই (৫ জুন) তার এই প্রস্তাব আমলে না নিয়ে উল্টো গ্যাসের দাম ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
বিইআরসির হিসেবে, দেশে বর্তমানে দৈনিক কমবেশি ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এ থেকে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরে সিস্টেম লস হয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ করে। এই হিসেবে দৈনিক সিস্টেম লসের পরিমাণ ২৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে কারিগরি ও অন্যান্য দিক বিবেচনায় গ্যাসের আদর্শ সিস্টেম লস ধরা হয় সর্বোচ্চ ২ দশমিক ২৫ শতাংশ। এরমধ্যে বিতরণে ২ শতাংশ এবং সঞ্চালনে দশমিক ২৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল সম্প্রতি গণশুনানিতে বলেছেন, গ্যাসের আদর্শ সিস্টেম লস হচ্ছে ২ শতাংশের নিচে। বিশ্বের কোথাও ২ শতাংশের উপরে সিস্টেম লস নেই। সাড়ে ৮ শতাংশ সিস্টেম লস গ্রহণযোগ্য নয়। এই মাত্রা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে।
বিইআরসির চেয়ারম্যানের দেওয়া তথ্যে দিনে প্রায় ৬ শতাংশ গ্যাস চুরি হচ্ছে যা চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে সিস্টেম লসের নামে। দৈনিক চুরি যাওয়া গ্যাসের পরিমাণ প্রায় ১৮০ থেকে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। অন্যদিকে চড়াদামে স্পট মার্কেট থেকে আমদানি করা এলএনজির পরিমাণ মাত্র ৯৯ মিলিয়ন ঘনফুট। স্পট মার্কেটের এলএনজির মূল্যের (ঘনমিটার ৫০ টাকা আমদানি শুল্কসহ) সঙ্গে তুলনা করলে দৈনিক চুরি যাওয়া ৬ শতাংশ গ্যাসের মূল্য দাঁড়ায় ৩৪৫ কোটি টাকা। যা বছরে এক লাখ তিন হাজার পাঁচশত কোটি টাকার মতো।
এই চুরির পরিমাণটি সরল অংকের হিসেবে। আরেকটি অংক রয়েছে, আবাসিকের মিটারবিহীন ৩৪ লাখ গ্রাহক রয়েছেন, যারা প্রতি মাসে গড়ে ৪০ ঘনমিটারের নিচে গ্যাস ব্যবহার করেন। কিন্তু প্রতিমাসে তারা প্রত্যেকে ৭৮ ঘনমিটারের বিল দিয়ে আসছেন। এই বাড়তি ৩৮ ঘনমিটারের বিলের টাকা চলে যায় কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর পকেটে।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছিলেন, ‘প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের পাইলট প্রকল্পের রেজাল্ট খুব ভালো। দুই চুলায় মাসে ৩৩ ঘন মিটার গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে।’
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্য মতে, দেশে বৈধ আবাসিক গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৩৮ লাখ। এদের মধ্যে মধ্যে তিন লাখ ৬৮ হাজার প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ প্রতিমাসে সাড়ে ৩৪ লাখ গ্রাহকের পকেট কাটা হচ্ছে। মাসে গড়ে পাঁচশ টাকা হারে ধরা হলেও মোট টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ হিসেবে বছরে দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই টাকার কারণে সিস্টেম গেইন করার কথা অর্থাৎ প্রকৃত সিস্টেম লসের পরিমাণ ১২ শতাংশের উপর হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছে।
সাদা চোখে দেখা এই চুরির প্রায় পুরোটাই বিতরণ সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি অধিভুক্ত এলাকায়। অল্প পরিমাণে রয়েছে কুমিল্লা-চাঁদপুর অঞ্চলে বিতরণ কোম্পানি বিজিডিসিএল ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিতরণ কোম্পানি কেজিডিসিএল-এ। তিতাসের চুরি আগে থেকেই ওপেন সিক্রেট।
কোম্পানিটি সম্প্রতি চাপের মুখে জোনগুলোকে পৃথক করার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে বেশকিছু জোনে পৃথক মিটার বসানো হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ আড়াইহাজার জোনে ৩০ শতাংশের উপরে সিস্টেম লস ধরা পড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
তবে এ তথ্য সঠিক নয় উল্লেখ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘কে দিয়েছে এই তথ্য?’ তার কাছে প্রকৃত তথ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি মুখস্ত বলতে পারবো না। জোন কতটি সে বিষয়েও আমার মুখস্ত নেই।’
সিস্টেম লসের কথা জানতে চাইলে তিতাস গ্যাসের পরিচালক (অপরেশন, চলতি দায়িত্ব) প্রকৌশলী সেলিম মিয়া বেলেন, ‘সাংবাদিক কি এই তথ্য চাইতে পারে? আপনার এই তথ্য দিয়ে কি দরকার? আপনি কোন এলাকায় গ্যাস থাকবে, কোন এলাকায় থাকবে না এটা জানতে চাইতে পারেন। সিস্টেম লস কি দরকার?’
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির গণশুনানিতে অংশ নিয়ে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, তিতাসের এতো বদনাম, আমরা কাজ করতে পারছি না। হয়তো ৫-১০ শতাংশ স্টাফ দুনীতিতে জড়িত থাকতে পারে। তিনি আরও বলেন, ‘অনেকে বলেন গ্যাসের অবৈধ সংযোগ রয়েছে, তিতাস কিছু করে না। আমাদের হাজার হাজার, লাখ লাখ অবৈধ সংযোগ রয়েছে। আমরা কাটছি, তারা আবার লাগাচ্ছে। ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে, আমাদের লোকবল কম তাদের সঙ্গে পেরে উঠছি না। অবৈধ সংযোগ প্রতিরোধে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।’
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যুক্তি হিসেবে পেট্রোবাংলা বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে গেছে। স্পট মার্কেট থেকে চড়া দরে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। তাদের তথ্যে দেখা গেছে, গত অর্থবছরে গড়ে দৈনিক ৯৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা হয়েছে। সে হিসেবে স্পট মার্কেট থেকে আমদানি করা গ্যাসের পরিমাণ মাত্র ৩ শতাংশ। এ জন্য ১১৭ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। অন্যদিকে বিইআরসি কারিগরি কমিটি ২০ শতাংশ দাম বৃদ্ধির সুপারিশ করে। ইতিমধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে।
তিতাস গ্যাসে যে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয় তা বেড়িয়ে আসে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানেও। দীর্ঘ দিন অনুসসন্ধানের পর নানা খাতে দুর্নীতির ২২ উৎস চিহ্নিত করে এবং তা প্রতিরোধে ১২ দফা সুপারিশ করে প্রতিবেদন তৈরি করে সংস্থাটি। এই প্রতিবেদন ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর কাছে দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তিতাসে গ্যাস সংযোগে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ না করা, অবৈধ সংযোগ দেওয়া, মিটার টেম্পারিং করা, কম গ্যাস সরবরাহ করেও সিস্টেম লস দেখানো এবং বাণিজ্যিক গ্রাহককে শিল্প শ্রেণির গ্রাহক হিসেবে সংযোগ দেওয়া, অবৈধ সংযোগ নিতেও তিতাসের কর্মচারীকে ৪৫ হাজার টাকা ঘুষ প্রদান সহ ২২টি বিষয়কে দুর্নীতির উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনকি শুধু রাজধানীর আশপাশে ৫ এলাকায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৪৫৫ অবৈধ সংযোগ চিহ্নিত করা হয় সে সময়।
গ্যাস বিতরণের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তিতাসের এমন সব দুর্নীতি সামনে এসেছে যা পুরোপুরি অভিনব। গভীর রাতে সার্ভারে ঢুকে অবৈধ গ্রাহককে বৈধ করার। রাতের আধারে কোম্পানির সার্ভারে এন্ট্রি দিয়ে বৈধ করার অভিযোগে ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে মামলা করে তিতাস। প্রাথমিকভাবে এক রাতেই এক হাজার ২৪৭টি সংযোগ বৈধ করে দেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর ভাটারা থানায় মামলাটি (৭ সেপ্টেম্বর ২০২০) দায়ের করা হয়।
আবার এমন ঘটনা ঘটেছে গ্রাহকরা বিল জমা দিয়েছেন, কিন্তু সেই বিল জমা হয়নি লেজারে। কিছু অসাধু কর্মকর্তা গ্রাহকদের এসব টাকা মেরে দিয়েছেন। আর ঘটনাটি ধরে পড়ে বকেয়ার দায়ে লাইন কাটতে গেলে। গ্রাহক তখন তাদের জমার রশিদ দেখান। এই ঘটনাটি ধরা পড়েছে গত জানুয়ারি মাসের দিকে।
সম্প্রতি আরেকটি হাস্যকর ঘটনার জন্ম দিয়েছে বিতর্কিত এই তিতাস গ্যাস সংস্থাটি। বাহবা নেওয়ার জন্য বিশাল এলাকা জুড়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার খবরের বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয় গণমাধ্যমে। গত ২৫ মে পাঠানো সেই বিজ্ঞপ্তিতে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ইমামপুর বাঘাবন্দি (বাঘাইয়াকান্দি) গ্রামের নাম লেখা হয়। কিন্তু গ্রামবাসী দাবী করেছেন তাদের এলাকায় কখনোই গ্যাসের লাইন ছিল না। তাহলে কাটলো কিভাবে। এই ঘটনায় বেশ হাস্যরসের জন্ম দেয়। অন্যদিকে কেজি মেপে ঘুষ খাওয়ার ঘটনাও তিতাসের সৃষ্টি।
হরলাল রায় সাগর
১৩ জুন, ২০২২, 1:08 AM

বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লসের নামে গ্যাস চুরি থামছে না কোনভাবেই। এই সিস্টেমে মাসে চুরি হচ্ছে প্রায় ৬ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস, যার দাম আমদানি মূল্যে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং বিতরণ কোম্পানিগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র। মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিতরণ কোম্পানিগুলোর একশ্রেনীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেট ভারী হচ্ছে এই টাকায় বলে অভিযোগ বহু পুরানো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুরির পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ কমানো গেলেও স্পট মার্কেট তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে হত না। আর স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস আমদানি করতে না হলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। মুনাফায় থাকা গ্যাসের ৬টি বিতরণ কোম্পানি দাম না বাড়িয়ে বিদ্যমান বিতরণ চার্জ (প্রতি ঘনমিটার ২৫ পয়সা) বাতিল করলেও চলে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন খোদ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)-এর করিগরি কমিটি। আর এতে ভোক্তাদেরও বাড়তি বিলের বোঝা বহন করতে হত না।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে নানা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির ২২টি উৎস চিহ্নিত করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। এসব দুর্নীতি বন্ধে ২০১৯ সালের এপ্রিলে ১২ দফা সুপারিশও করা হয়। কিন্তু সেই সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়নি আর লুটপাটও বন্ধ হয়নি।
কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম সম্প্রতি গ্যাসের দাম বাড়ানোর গণশুনানীকালে বলেছিলেন, ‘আমরা মনে করি চুরি ঠেকানো গেলে স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। তখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর বদলে কমানো যাবে। আমরা হিসেব করে দেখিয়ে দিয়েছি গ্যাসের দাম প্রতি ঘনফুট ১৬ পয়সা কমানো যায়।’
কিন্তু কয়েকদিন পরেই (৫ জুন) তার এই প্রস্তাব আমলে না নিয়ে উল্টো গ্যাসের দাম ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
বিইআরসির হিসেবে, দেশে বর্তমানে দৈনিক কমবেশি ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এ থেকে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরে সিস্টেম লস হয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ করে। এই হিসেবে দৈনিক সিস্টেম লসের পরিমাণ ২৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে কারিগরি ও অন্যান্য দিক বিবেচনায় গ্যাসের আদর্শ সিস্টেম লস ধরা হয় সর্বোচ্চ ২ দশমিক ২৫ শতাংশ। এরমধ্যে বিতরণে ২ শতাংশ এবং সঞ্চালনে দশমিক ২৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল সম্প্রতি গণশুনানিতে বলেছেন, গ্যাসের আদর্শ সিস্টেম লস হচ্ছে ২ শতাংশের নিচে। বিশ্বের কোথাও ২ শতাংশের উপরে সিস্টেম লস নেই। সাড়ে ৮ শতাংশ সিস্টেম লস গ্রহণযোগ্য নয়। এই মাত্রা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে।
বিইআরসির চেয়ারম্যানের দেওয়া তথ্যে দিনে প্রায় ৬ শতাংশ গ্যাস চুরি হচ্ছে যা চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে সিস্টেম লসের নামে। দৈনিক চুরি যাওয়া গ্যাসের পরিমাণ প্রায় ১৮০ থেকে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। অন্যদিকে চড়াদামে স্পট মার্কেট থেকে আমদানি করা এলএনজির পরিমাণ মাত্র ৯৯ মিলিয়ন ঘনফুট। স্পট মার্কেটের এলএনজির মূল্যের (ঘনমিটার ৫০ টাকা আমদানি শুল্কসহ) সঙ্গে তুলনা করলে দৈনিক চুরি যাওয়া ৬ শতাংশ গ্যাসের মূল্য দাঁড়ায় ৩৪৫ কোটি টাকা। যা বছরে এক লাখ তিন হাজার পাঁচশত কোটি টাকার মতো।
এই চুরির পরিমাণটি সরল অংকের হিসেবে। আরেকটি অংক রয়েছে, আবাসিকের মিটারবিহীন ৩৪ লাখ গ্রাহক রয়েছেন, যারা প্রতি মাসে গড়ে ৪০ ঘনমিটারের নিচে গ্যাস ব্যবহার করেন। কিন্তু প্রতিমাসে তারা প্রত্যেকে ৭৮ ঘনমিটারের বিল দিয়ে আসছেন। এই বাড়তি ৩৮ ঘনমিটারের বিলের টাকা চলে যায় কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর পকেটে।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছিলেন, ‘প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের পাইলট প্রকল্পের রেজাল্ট খুব ভালো। দুই চুলায় মাসে ৩৩ ঘন মিটার গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে।’
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্য মতে, দেশে বৈধ আবাসিক গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৩৮ লাখ। এদের মধ্যে মধ্যে তিন লাখ ৬৮ হাজার প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ প্রতিমাসে সাড়ে ৩৪ লাখ গ্রাহকের পকেট কাটা হচ্ছে। মাসে গড়ে পাঁচশ টাকা হারে ধরা হলেও মোট টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ হিসেবে বছরে দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই টাকার কারণে সিস্টেম গেইন করার কথা অর্থাৎ প্রকৃত সিস্টেম লসের পরিমাণ ১২ শতাংশের উপর হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছে।
সাদা চোখে দেখা এই চুরির প্রায় পুরোটাই বিতরণ সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি অধিভুক্ত এলাকায়। অল্প পরিমাণে রয়েছে কুমিল্লা-চাঁদপুর অঞ্চলে বিতরণ কোম্পানি বিজিডিসিএল ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিতরণ কোম্পানি কেজিডিসিএল-এ। তিতাসের চুরি আগে থেকেই ওপেন সিক্রেট।
কোম্পানিটি সম্প্রতি চাপের মুখে জোনগুলোকে পৃথক করার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে বেশকিছু জোনে পৃথক মিটার বসানো হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ আড়াইহাজার জোনে ৩০ শতাংশের উপরে সিস্টেম লস ধরা পড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
তবে এ তথ্য সঠিক নয় উল্লেখ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘কে দিয়েছে এই তথ্য?’ তার কাছে প্রকৃত তথ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি মুখস্ত বলতে পারবো না। জোন কতটি সে বিষয়েও আমার মুখস্ত নেই।’
সিস্টেম লসের কথা জানতে চাইলে তিতাস গ্যাসের পরিচালক (অপরেশন, চলতি দায়িত্ব) প্রকৌশলী সেলিম মিয়া বেলেন, ‘সাংবাদিক কি এই তথ্য চাইতে পারে? আপনার এই তথ্য দিয়ে কি দরকার? আপনি কোন এলাকায় গ্যাস থাকবে, কোন এলাকায় থাকবে না এটা জানতে চাইতে পারেন। সিস্টেম লস কি দরকার?’
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির গণশুনানিতে অংশ নিয়ে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, তিতাসের এতো বদনাম, আমরা কাজ করতে পারছি না। হয়তো ৫-১০ শতাংশ স্টাফ দুনীতিতে জড়িত থাকতে পারে। তিনি আরও বলেন, ‘অনেকে বলেন গ্যাসের অবৈধ সংযোগ রয়েছে, তিতাস কিছু করে না। আমাদের হাজার হাজার, লাখ লাখ অবৈধ সংযোগ রয়েছে। আমরা কাটছি, তারা আবার লাগাচ্ছে। ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে, আমাদের লোকবল কম তাদের সঙ্গে পেরে উঠছি না। অবৈধ সংযোগ প্রতিরোধে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।’
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যুক্তি হিসেবে পেট্রোবাংলা বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে গেছে। স্পট মার্কেট থেকে চড়া দরে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। তাদের তথ্যে দেখা গেছে, গত অর্থবছরে গড়ে দৈনিক ৯৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা হয়েছে। সে হিসেবে স্পট মার্কেট থেকে আমদানি করা গ্যাসের পরিমাণ মাত্র ৩ শতাংশ। এ জন্য ১১৭ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। অন্যদিকে বিইআরসি কারিগরি কমিটি ২০ শতাংশ দাম বৃদ্ধির সুপারিশ করে। ইতিমধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে।
তিতাস গ্যাসে যে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয় তা বেড়িয়ে আসে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানেও। দীর্ঘ দিন অনুসসন্ধানের পর নানা খাতে দুর্নীতির ২২ উৎস চিহ্নিত করে এবং তা প্রতিরোধে ১২ দফা সুপারিশ করে প্রতিবেদন তৈরি করে সংস্থাটি। এই প্রতিবেদন ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর কাছে দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তিতাসে গ্যাস সংযোগে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ না করা, অবৈধ সংযোগ দেওয়া, মিটার টেম্পারিং করা, কম গ্যাস সরবরাহ করেও সিস্টেম লস দেখানো এবং বাণিজ্যিক গ্রাহককে শিল্প শ্রেণির গ্রাহক হিসেবে সংযোগ দেওয়া, অবৈধ সংযোগ নিতেও তিতাসের কর্মচারীকে ৪৫ হাজার টাকা ঘুষ প্রদান সহ ২২টি বিষয়কে দুর্নীতির উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনকি শুধু রাজধানীর আশপাশে ৫ এলাকায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৪৫৫ অবৈধ সংযোগ চিহ্নিত করা হয় সে সময়।
গ্যাস বিতরণের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তিতাসের এমন সব দুর্নীতি সামনে এসেছে যা পুরোপুরি অভিনব। গভীর রাতে সার্ভারে ঢুকে অবৈধ গ্রাহককে বৈধ করার। রাতের আধারে কোম্পানির সার্ভারে এন্ট্রি দিয়ে বৈধ করার অভিযোগে ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে মামলা করে তিতাস। প্রাথমিকভাবে এক রাতেই এক হাজার ২৪৭টি সংযোগ বৈধ করে দেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর ভাটারা থানায় মামলাটি (৭ সেপ্টেম্বর ২০২০) দায়ের করা হয়।
আবার এমন ঘটনা ঘটেছে গ্রাহকরা বিল জমা দিয়েছেন, কিন্তু সেই বিল জমা হয়নি লেজারে। কিছু অসাধু কর্মকর্তা গ্রাহকদের এসব টাকা মেরে দিয়েছেন। আর ঘটনাটি ধরে পড়ে বকেয়ার দায়ে লাইন কাটতে গেলে। গ্রাহক তখন তাদের জমার রশিদ দেখান। এই ঘটনাটি ধরা পড়েছে গত জানুয়ারি মাসের দিকে।
সম্প্রতি আরেকটি হাস্যকর ঘটনার জন্ম দিয়েছে বিতর্কিত এই তিতাস গ্যাস সংস্থাটি। বাহবা নেওয়ার জন্য বিশাল এলাকা জুড়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার খবরের বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয় গণমাধ্যমে। গত ২৫ মে পাঠানো সেই বিজ্ঞপ্তিতে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ইমামপুর বাঘাবন্দি (বাঘাইয়াকান্দি) গ্রামের নাম লেখা হয়। কিন্তু গ্রামবাসী দাবী করেছেন তাদের এলাকায় কখনোই গ্যাসের লাইন ছিল না। তাহলে কাটলো কিভাবে। এই ঘটনায় বেশ হাস্যরসের জন্ম দেয়। অন্যদিকে কেজি মেপে ঘুষ খাওয়ার ঘটনাও তিতাসের সৃষ্টি।