আদিবাসীদের পানির সংকট: বরেন্দ্র ভূমির আদিবাসী-প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ

নাগরিক ডেস্ক
২৮ এপ্রিল, ২০২৩, 11:45 AM

আদিবাসীদের পানির সংকট: বরেন্দ্র ভূমির আদিবাসী-প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ
মিথুশিলাক মুরমু
‘জিউই বানচাও লাগিতে দ্য হাতাই আলে’ (জীবন বাঁচাতে পানি চাই) লেখা ব্যানার হাতে নিয়ে রাজশাহীতে সম্প্রতি মানববন্ধন করেছে আদিবাসী মাহালী জনগোষ্ঠী। তারা ডিসিকে এ বিষয়ে স্মারকলিপিও দিয়েছে। রাজশাহী শহর থেকে মাহালীপাড়ার দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। বরেন্দ্র অঞ্চলের পৌরশহর মুন্ডুমাল, তার চেয়ে আধা কিলোমিটারে দূরে অবস্থিত মাহালীপাড়া।
আদিবাসী বাসিন্দা চিচিলিয়া হেমব্রম বলছিলেন- ‘দীর্ঘদিন ধরে মাহালীপাড়ায় কোনো পানি নেই। খাওয়ার পানি সংগ্রহ করার জন্য বাসা থেকে এক কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। সেখানেও অনেক সময় পানি পাওয়া যায় না। অন্য উৎস থেকে পানি আনতে নানান ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয় নারীদের। অভাবের সংসারে পানি কিনে খাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’
কয়েক দশক আগেও বরেন্দ্র অঞ্চলে সুপেয় পানীর এত অভাব ছিলো না। প্রতিটি গ্রামে কূপ ছিলো। কূপই ছিলো গ্রামের মানুষের ভরসাস্থল। বড়দিঘী কিংবা গভীর পুকুরের টলটলে পানিতে গ্রামের কৃষক-শ্রমিকদের তৃষ্ণা মিটত। মাঠে হালচাষ করতে গিয়ে জমিতে জমে থাকা পানিও তারা প্রায়ই খেয়েছেন। এখন পুকুর, দিঘী কিংবা ছোটখাটো ডোবাতেও মাছ চাষ করা হচ্ছে, মাছের খাবার দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে জলাশয়ের পানি জনসাধারণের ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। এখন সুপেয় পানির জন্য চাঁদা তুলে মোটর বসানো হচ্ছে, পানির ট্যাঙ্ক বসানো হচ্ছে। অর্থাৎ খাবার পানির জন্যে এখন বাড়তি চিন্তা ও খরচ করতে হচ্ছে। বরেন্দ্র ভূমির আদিবাসী-প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে নিরাপদ পানির জোগান দেওয়া।
গত এক দশকে উত্তর-পশ্চিমের জেলাগুলোতে বিশেষ করে রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অধিকাংশ জায়গায় জলধারক স্তর (অ্যাকুইফার) পাওয়া যাচ্ছে না। খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানভিত্তিক সংস্থা কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশনের নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণায় দেশের পাঁচটি সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত ছিলো। ১৯৮৫ থেকে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ওই অঞ্চলের ৩২৮টি টিউবওয়েলে পানির ওঠানামা পরীক্ষা থেকে জানা গেছে, সব জায়গায় পানি সমানভাবে কমছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর কারণ হচ্ছে প্রথমত, বরেন্দ্র এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি বৃষ্টিপাত কিংবা বৃষ্টির তীব্রতা কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, সেচসহ অন্যান্য কাজে ভূগর্ভস্থ পানির যথেচ্ছ ব্যবহার।
দেশে পানীয় জলের জন্য ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। বিশ্বব্যাংক, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৯৮ ভাগ মানুষের জন্য পানির কোনো না কোনো উৎস রয়েছে। কিন্তু এর সবটাই পানযোগ্য নয়। নিরাপদ বা সুপেয় পানি পাচ্ছে শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশ সরকারের জয়েণ্ট মনিটরিং প্রোগ্রামের সর্বশেষ হিসেবে অনুযায়ী তা ৮৭ ভাগ। তবে পানির দূষণ হিসাব করলে ৪৪ ভাগ মানুষে নিরাপদ ও সুপেয় পানির আওতার বাইরে আছেন। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘দেশের ৯৮-৯৯ শতাংশ মানুষ সাধারণভাবে পানির সুবিধা পেলেও গুণগত মানসম্পন্ন নিরাপদ পানি এখনো সবার জন্য নিশ্চিত করা যায়নি।’ তাই সমন্বিতভাবে উদ্যোগের মাধ্যমে এ পানি ব্যবস্থাপনায় কাজ করা উচিত। এ বছর বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষ্যে গণমাধ্যমে পাহাড়ি অঞ্চলের নারীদের পানি সংগ্রহের সংগ্রামের ছবিগুলো প্রকাশিত হলে সবার নজর কাড়ে। দেখা গেছে, দূরবর্তী পাহাড়ি ঝিরি, ঝরণা থেকে পাহাড়ি নারীরা খাবার পানি সংগ্রহ করছে। খাবার পানি সংগ্রহ করতে গিয়েই তাদের অধিকাংশ সময় ব্যয় হচ্ছে। পরিবারের অন্যান্য কাজকর্ম সামান্যই করতে পারছেন তারা।
জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাঙ্গামাটি ৪০%, বান্দরবানে ৫৩% এবং খাগড়াছড়িতে ৫৬% মানুষের পানীয় জলের ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছে। বাকিরা নির্ভর করে প্রাকৃতিক উৎসের উপর। জায়গা ভেদে অর্থাৎ রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি ও আলীকদমের ৮০ শতাংশ মানুষ নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল।
অপরদিকে নেত্রকোনার কলমাকান্দা বিশেষত গারো, হাজংরা পানীয় জলের অভাবে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে। কলমাকান্দা ইউনিয়নের লেংগুরা, খারনৈ, রংছাতিসহ প্রায় ৩৫টি গ্রামের ১৮ হাজার মানুষ পানির নিদারুণ সংকটে ভুগছে । খাবার পানি আনতে সকাল-বিকেল ছুটতে হয় এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল আদিবাসী গারো, হাজং পরিবারগুলো চরম সংকটে পড়েছে।
শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বুরুঙ্গা, কোচপাড়া, কালাপানি, বাতকুচি, আন্ধারুপাড়া ও লক্ষ্মীকুড়া আদিবাসী গারো, কোচ’রা বছরের পর বছর নিরাপদ পানীয় জল সংগ্রহ করে থাকে আধা কিলোমিটার থেকে দেড় কিলোমিটার দূরবর্তী এলাকা থেকে। খাল ও টিলা পেরিয়ে পানি আনতে হয়। বর্ষা বাদলের দিনে বেশি কষ্ট করতে হয়। সময় বিশেষে খননকৃত কূপের পানিই খাওয়া ও গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা হয়। তথ্য অনুযায়ী, অত্র পাহাড়ি এলাকায় সাধারণত গভীর নলকূপ করা যায় না। ১০০ থেকে ১৫০ ফুট খননের (বোরিং) পর আর গভীরে যাওয়া যায় না। শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের ছোট গজনী গ্রামের আদিবাসী বাসিন্দা বর্ষার আকুতি, ‘এহন আমাগোর খাওয়ার পানির খুবই অভাব। অনেকবার সাহায্যের কথা বলেও আমরা কোন সাহায্যই পাচ্ছি না। এহন সরকারের কাছে দাবি, যাতে আমাগোর পানির অভাব দূর কইরা দেন।’ অনেকে ক্ষোভের সাথেই বলেছে, সরকার সব উন্নয়ন করছে, কিন্তু গারোদের পানির দুঃখ দূর করছে না। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারল না তারা। পানির সংকটের কারণে ছড়া বা টিলার নিচের অগভীর কূপের ময়লা পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে গারো ও হাজংদের।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, বিশে^র চার ভাগের এক ভাগ মানুষ এখনো সুপেয় পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। পানির ব্যবহার নিয়ে মানবজাতিকে নতুন করে ভাবতে হবে। অর্থাৎ বিশে^ প্রতি ৪ জন মানুষের একজন নিরাপদ পানির অভাবে ভুগছে। এ বছর বিশ্ব পানি দিবসে জাতিসংঘে ১০ হাজার প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন এবং পানি সম্পদ রক্ষায় ৭০০ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কানাডার ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক গ্রাহাম কোগলি’র মতে, ‘ইন্দো-গাঙ্গেয় সমতলে, অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রায় ৬০ কোটি মানুষের বাস এবং তারা খুবই অনিয়ন্ত্রিত ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ হারে মাটির নিচের পানি তুলে ফেলছে।’
এসডিজি ৬ অনুসারে ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শতভাগ মানুষের কাছে নিরাপদ পানি পৌঁছাতে হবে। কিন্তুঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ-এর মতে, দেশের নিরাপদ পানি পৌঁছানো গেছে ৫৯ শতাংশ মানুষের কাছে। দূর্গম এলাকা, গ্রামাঞ্চল ও শহরের বস্তি এলাকায় নিরাপদ পানি সহজে পাওয়া যায় না। পানিতে জীবানু, আর্সেনিক ও লবণাক্ততা রয়েছে। এসডিজি লক্ষ্য পূরণ করতে হলে নিরাপদ পানির জন্য এখন কমপক্ষে চারগুণ সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশে বহু মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে না। খাওয়ার পানি নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপাকে রয়েছেন প্রান্তিক ও দুর্গম পাহাড়ি জনপদের মানুষ। অঞ্চলভেদে আদিবাসীদের দাবি-দাওয়ার ভিন্নতা রয়েছে। পাহাড়ের আদিবাসীরা অবাধে পাথর উত্তোলন, নির্বিচারে গাছপালা কাটা, পাহাড়ের পাদদেশের মাটি স্থানান্তর ইত্যাদি বন্ধ করতে বার বার সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। বরেন্দ্রাঞ্চলের আদিবাসীদের দাবি হচ্ছে- গভীর নলকূপ স্থাপন, সরকার পুকুর-দীঘি ইজারা না দিয়ে প্রান্তিক মানুষদের ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া, গ্রামের ভেতর বা কাছাকাছি পুকুরগুলো গ্রামবাসীর নামে বিনাশর্তে ইজারা দেওয়া এবং পুকুর-দিঘীগুলো সংস্কার করা। অবহেলিত আদিবাসীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্ব করে টিকে থাকা মানুষগুলোর জীবনযাত্রা সুপেয় পানির অভাবে আরো দুঃসহ হয়ে উঠেছে। প্রান্তিক মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় সুবিধাদি না পৌঁছানোর জন্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, অপর্যাপ্ত বাজেট, সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা ও অসচেতনাই অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন গবেষণায়।
আশা করি, সরকার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। এতে আদিবাসীদের কষ্ট লাঘব হবে।
[লেখক : কলামিস্ট]
নাগরিক ডেস্ক
২৮ এপ্রিল, ২০২৩, 11:45 AM

মিথুশিলাক মুরমু
‘জিউই বানচাও লাগিতে দ্য হাতাই আলে’ (জীবন বাঁচাতে পানি চাই) লেখা ব্যানার হাতে নিয়ে রাজশাহীতে সম্প্রতি মানববন্ধন করেছে আদিবাসী মাহালী জনগোষ্ঠী। তারা ডিসিকে এ বিষয়ে স্মারকলিপিও দিয়েছে। রাজশাহী শহর থেকে মাহালীপাড়ার দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। বরেন্দ্র অঞ্চলের পৌরশহর মুন্ডুমাল, তার চেয়ে আধা কিলোমিটারে দূরে অবস্থিত মাহালীপাড়া।
আদিবাসী বাসিন্দা চিচিলিয়া হেমব্রম বলছিলেন- ‘দীর্ঘদিন ধরে মাহালীপাড়ায় কোনো পানি নেই। খাওয়ার পানি সংগ্রহ করার জন্য বাসা থেকে এক কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। সেখানেও অনেক সময় পানি পাওয়া যায় না। অন্য উৎস থেকে পানি আনতে নানান ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয় নারীদের। অভাবের সংসারে পানি কিনে খাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’
কয়েক দশক আগেও বরেন্দ্র অঞ্চলে সুপেয় পানীর এত অভাব ছিলো না। প্রতিটি গ্রামে কূপ ছিলো। কূপই ছিলো গ্রামের মানুষের ভরসাস্থল। বড়দিঘী কিংবা গভীর পুকুরের টলটলে পানিতে গ্রামের কৃষক-শ্রমিকদের তৃষ্ণা মিটত। মাঠে হালচাষ করতে গিয়ে জমিতে জমে থাকা পানিও তারা প্রায়ই খেয়েছেন। এখন পুকুর, দিঘী কিংবা ছোটখাটো ডোবাতেও মাছ চাষ করা হচ্ছে, মাছের খাবার দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে জলাশয়ের পানি জনসাধারণের ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। এখন সুপেয় পানির জন্য চাঁদা তুলে মোটর বসানো হচ্ছে, পানির ট্যাঙ্ক বসানো হচ্ছে। অর্থাৎ খাবার পানির জন্যে এখন বাড়তি চিন্তা ও খরচ করতে হচ্ছে। বরেন্দ্র ভূমির আদিবাসী-প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে নিরাপদ পানির জোগান দেওয়া।
গত এক দশকে উত্তর-পশ্চিমের জেলাগুলোতে বিশেষ করে রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অধিকাংশ জায়গায় জলধারক স্তর (অ্যাকুইফার) পাওয়া যাচ্ছে না। খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানভিত্তিক সংস্থা কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশনের নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণায় দেশের পাঁচটি সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত ছিলো। ১৯৮৫ থেকে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ওই অঞ্চলের ৩২৮টি টিউবওয়েলে পানির ওঠানামা পরীক্ষা থেকে জানা গেছে, সব জায়গায় পানি সমানভাবে কমছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর কারণ হচ্ছে প্রথমত, বরেন্দ্র এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি বৃষ্টিপাত কিংবা বৃষ্টির তীব্রতা কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, সেচসহ অন্যান্য কাজে ভূগর্ভস্থ পানির যথেচ্ছ ব্যবহার।
দেশে পানীয় জলের জন্য ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। বিশ্বব্যাংক, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৯৮ ভাগ মানুষের জন্য পানির কোনো না কোনো উৎস রয়েছে। কিন্তু এর সবটাই পানযোগ্য নয়। নিরাপদ বা সুপেয় পানি পাচ্ছে শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশ সরকারের জয়েণ্ট মনিটরিং প্রোগ্রামের সর্বশেষ হিসেবে অনুযায়ী তা ৮৭ ভাগ। তবে পানির দূষণ হিসাব করলে ৪৪ ভাগ মানুষে নিরাপদ ও সুপেয় পানির আওতার বাইরে আছেন। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘দেশের ৯৮-৯৯ শতাংশ মানুষ সাধারণভাবে পানির সুবিধা পেলেও গুণগত মানসম্পন্ন নিরাপদ পানি এখনো সবার জন্য নিশ্চিত করা যায়নি।’ তাই সমন্বিতভাবে উদ্যোগের মাধ্যমে এ পানি ব্যবস্থাপনায় কাজ করা উচিত। এ বছর বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষ্যে গণমাধ্যমে পাহাড়ি অঞ্চলের নারীদের পানি সংগ্রহের সংগ্রামের ছবিগুলো প্রকাশিত হলে সবার নজর কাড়ে। দেখা গেছে, দূরবর্তী পাহাড়ি ঝিরি, ঝরণা থেকে পাহাড়ি নারীরা খাবার পানি সংগ্রহ করছে। খাবার পানি সংগ্রহ করতে গিয়েই তাদের অধিকাংশ সময় ব্যয় হচ্ছে। পরিবারের অন্যান্য কাজকর্ম সামান্যই করতে পারছেন তারা।
জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাঙ্গামাটি ৪০%, বান্দরবানে ৫৩% এবং খাগড়াছড়িতে ৫৬% মানুষের পানীয় জলের ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছে। বাকিরা নির্ভর করে প্রাকৃতিক উৎসের উপর। জায়গা ভেদে অর্থাৎ রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি ও আলীকদমের ৮০ শতাংশ মানুষ নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল।
অপরদিকে নেত্রকোনার কলমাকান্দা বিশেষত গারো, হাজংরা পানীয় জলের অভাবে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে। কলমাকান্দা ইউনিয়নের লেংগুরা, খারনৈ, রংছাতিসহ প্রায় ৩৫টি গ্রামের ১৮ হাজার মানুষ পানির নিদারুণ সংকটে ভুগছে । খাবার পানি আনতে সকাল-বিকেল ছুটতে হয় এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল আদিবাসী গারো, হাজং পরিবারগুলো চরম সংকটে পড়েছে।
শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বুরুঙ্গা, কোচপাড়া, কালাপানি, বাতকুচি, আন্ধারুপাড়া ও লক্ষ্মীকুড়া আদিবাসী গারো, কোচ’রা বছরের পর বছর নিরাপদ পানীয় জল সংগ্রহ করে থাকে আধা কিলোমিটার থেকে দেড় কিলোমিটার দূরবর্তী এলাকা থেকে। খাল ও টিলা পেরিয়ে পানি আনতে হয়। বর্ষা বাদলের দিনে বেশি কষ্ট করতে হয়। সময় বিশেষে খননকৃত কূপের পানিই খাওয়া ও গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা হয়। তথ্য অনুযায়ী, অত্র পাহাড়ি এলাকায় সাধারণত গভীর নলকূপ করা যায় না। ১০০ থেকে ১৫০ ফুট খননের (বোরিং) পর আর গভীরে যাওয়া যায় না। শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের ছোট গজনী গ্রামের আদিবাসী বাসিন্দা বর্ষার আকুতি, ‘এহন আমাগোর খাওয়ার পানির খুবই অভাব। অনেকবার সাহায্যের কথা বলেও আমরা কোন সাহায্যই পাচ্ছি না। এহন সরকারের কাছে দাবি, যাতে আমাগোর পানির অভাব দূর কইরা দেন।’ অনেকে ক্ষোভের সাথেই বলেছে, সরকার সব উন্নয়ন করছে, কিন্তু গারোদের পানির দুঃখ দূর করছে না। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারল না তারা। পানির সংকটের কারণে ছড়া বা টিলার নিচের অগভীর কূপের ময়লা পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে গারো ও হাজংদের।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, বিশে^র চার ভাগের এক ভাগ মানুষ এখনো সুপেয় পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। পানির ব্যবহার নিয়ে মানবজাতিকে নতুন করে ভাবতে হবে। অর্থাৎ বিশে^ প্রতি ৪ জন মানুষের একজন নিরাপদ পানির অভাবে ভুগছে। এ বছর বিশ্ব পানি দিবসে জাতিসংঘে ১০ হাজার প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন এবং পানি সম্পদ রক্ষায় ৭০০ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কানাডার ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক গ্রাহাম কোগলি’র মতে, ‘ইন্দো-গাঙ্গেয় সমতলে, অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রায় ৬০ কোটি মানুষের বাস এবং তারা খুবই অনিয়ন্ত্রিত ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ হারে মাটির নিচের পানি তুলে ফেলছে।’
এসডিজি ৬ অনুসারে ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শতভাগ মানুষের কাছে নিরাপদ পানি পৌঁছাতে হবে। কিন্তুঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ-এর মতে, দেশের নিরাপদ পানি পৌঁছানো গেছে ৫৯ শতাংশ মানুষের কাছে। দূর্গম এলাকা, গ্রামাঞ্চল ও শহরের বস্তি এলাকায় নিরাপদ পানি সহজে পাওয়া যায় না। পানিতে জীবানু, আর্সেনিক ও লবণাক্ততা রয়েছে। এসডিজি লক্ষ্য পূরণ করতে হলে নিরাপদ পানির জন্য এখন কমপক্ষে চারগুণ সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশে বহু মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে না। খাওয়ার পানি নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপাকে রয়েছেন প্রান্তিক ও দুর্গম পাহাড়ি জনপদের মানুষ। অঞ্চলভেদে আদিবাসীদের দাবি-দাওয়ার ভিন্নতা রয়েছে। পাহাড়ের আদিবাসীরা অবাধে পাথর উত্তোলন, নির্বিচারে গাছপালা কাটা, পাহাড়ের পাদদেশের মাটি স্থানান্তর ইত্যাদি বন্ধ করতে বার বার সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। বরেন্দ্রাঞ্চলের আদিবাসীদের দাবি হচ্ছে- গভীর নলকূপ স্থাপন, সরকার পুকুর-দীঘি ইজারা না দিয়ে প্রান্তিক মানুষদের ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া, গ্রামের ভেতর বা কাছাকাছি পুকুরগুলো গ্রামবাসীর নামে বিনাশর্তে ইজারা দেওয়া এবং পুকুর-দিঘীগুলো সংস্কার করা। অবহেলিত আদিবাসীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্ব করে টিকে থাকা মানুষগুলোর জীবনযাত্রা সুপেয় পানির অভাবে আরো দুঃসহ হয়ে উঠেছে। প্রান্তিক মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় সুবিধাদি না পৌঁছানোর জন্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, অপর্যাপ্ত বাজেট, সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা ও অসচেতনাই অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন গবেষণায়।
আশা করি, সরকার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। এতে আদিবাসীদের কষ্ট লাঘব হবে।
[লেখক : কলামিস্ট]