বাড়ছে গমের আমদানি নির্ভরতা, উৎপাদন ক্রমশ কমায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে খাদ্য নিরাপত্তা

জাহিদ হোসেন বিপ্লব
৩১ মে, ২০২২, 1:26 AM

বাড়ছে গমের আমদানি নির্ভরতা, উৎপাদন ক্রমশ কমায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে খাদ্য নিরাপত্তা
দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য গমের চাহিদা প্রতিদিন বাড়লেও উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় আমদানি-নির্ভর এই কৃষিপণ্যটির আমদানির পরিমাণ দিনদিন যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি এর পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তাও হয়ে পড়েছে ঝুঁকিপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, শুধু স্থানীয় উৎপাদনের ওপর ভরসা করে সামনের দিনগুলোর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর এক গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে গমের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২১ অনুযায়ী, গমের চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চললেও এর উৎপাদন নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকের তুলনায় ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে।
সরকারি তথ্য মোতাবেক, ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে দেশে গমের উৎপাদন হয়েছিল ১৯ লাখ আট হাজার টন। এটি এ পর্যন্ত বাংলাদেশে গমের সর্বোচ্চ উৎপাদন। এর পর থেকে গমের উৎপাদন কমতে থাকে এবং ২০০৬-০৭ অর্থবছরে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় সাত লাখ ২৫ হাজার টনে (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৯)।
এরপর অবশ্য পণ্যটির উৎপাদন কিছুটা বাড়তে থাকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে গমের উৎপাদন দাঁড়ায় ১২ লাখ ৪৬ হাজার টনে। এর আগের দুই অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১০ লাখ ৯৯ হাজার টন এবং ১১ লাখ ৪৮ হাজার টন। ২০২০-২১ অর্থবসরে গমের উৎপাদন ছিল ১১ লাখ ৬৭ হাজার টন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৭.৩৪ লাখ টন গম আমদানি করে যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরের চেয়ে ৩১লাখ টন বেশি।
এনবিআর তথ্য আরও বলছে, বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৫৫.৫ লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যেও দেখায় যে গত ২২ বছরে দু/এক বছরের ব্যাতিক্রম বাদ দিলে গমের চাষ ও উৎপাদন উভয়ই হ্রাস পেয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমআরএইউ) অধ্যাপক ও উদ্ভিদ জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের প্রধান তোফাজ্জল ইসলাম বলেন, ব্লাস্ট এবং ভয়ঙ্কর ছত্রাকজনিত রোগে ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশে গম চাষ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। সেই সময়ে যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, বরিশাল ও ভোলায় সরকার গম চাষের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যা এখন বহাল আছে।
গমের উৎপাদন কমে যাওয়ার জন্য যেসব কারণকে বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - (১) গম উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ শীতকাল যা একসময় ছিল বাংলাদেশে, কিন্তু এখন আর নেই। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনকে বাংলাদেশে শীতের স্থায়িত্ব কমার জন্য দায়ী করেছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। (২) গমের জমি ভুট্টা, আলু এবং স্বল্পমেয়াদি সব্জি চাষে চলে যাওয়ায় গম চাষের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তা ছাড়া শ্রমিক সংকট, ইঁদুরের উপদ্রব, মাড়াইয়ের সমস্যা এবং ভালো বীজের অভাবের কারনেও গম চাষে চাষিরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। (৩) গমের ব্লাস্ট রোগ বাংলাদেশে গম চাষের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম প্রধান অন্তরায় হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। গমের উৎপাদনশীলতা হ্রাসে এ রোগটির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) পরিসংখ্যাণ অনুসারে দেশে বছরে গমের চাহিদা কম-বেশি ৭০ লাখ টন। আর দেশে উৎপাদিত গমের পরিমাণ ১০ থেকে ১২ লাখ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই দেশে গমের চাহিদা মেটানোর প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে আমদানি।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও)-এর হিসাব মোতাবেক, বিশ্বের যে কয়টি দেশে সবচেয়ে দ্রুত হারে গমের আমদানি বাড়ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
গত কয়েক বছরে গম আমদানির তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশে গমের মোট চাহিদার পাঁচ ভাগের চার ভাগ মেটানো হয়েছে আমদানির মাধ্যমে। ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানি করা গমের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫৬ লাখ ৯ হাজার, ৫৭ লাখ ৭৯ হাজার, ৫৫ লাখ ৩৬ হাজার এবং ৬৩ লাখ ৬৬ হাজার টন (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২১)। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৩ লাখ ৪২ হাজার ৮০০ টন গম আমদানি হয়েছে বলে অন্য এক সূত্রে জানা যায়।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২১ সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে গম আমদানিতে ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে এক হাজার ৪৯৪, এক হাজার ৪৩৬ এবং এক হাজার ৬৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক, ড. দেবাশীষ সরকার বলেন, গত দুই দশক বা তারও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ গমের উৎপাদন বছরে ২০ লাখ টন থেকে হ্রাস পেয়ে মাত্র ১০ লাখ টনে এসে দাঁড়িয়েছে। যেখানে গমের চাহিদা বছরে প্রায় ৭০ লাখ টনে পৌঁছেছে। ফলস্বরূপ, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ দশ গম আমদানিকারক দেশগুলোর একটি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ভারত থেকে ব্যবসায়ীদের আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আপাতত দেশে গমের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মোকাবিলায় গমের মজুত বাড়ানো উচিত।
এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়ানো দরকার। কারণ, রাশিয়া ও ইউক্রেন গমের অন্যতম উৎস। অন্যান্য দেশও এখন বিকল্প উৎস থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করছে। তাতে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বলেন, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো গমের উৎপাদন বৃদ্ধি। মনে রাখতে হবে, দেশে দানাদার খাদ্যশস্য হিসাবে ধানের পরই গমের স্থান। আমাদের প্রথম লক্ষ্য হবে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরের উৎপাদন অবস্থায় ফিরে গিয়ে ২০ লাখ টন গম উৎপাদন করা। এরপর ধীরে ধীরে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা।
এজন্য উষ্ণ আবহাওয়া-সহনশীল জাতের গম উদ্ভাবনের ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি গম উৎপাদন অঞ্চল চিহ্নিত করে নিবিড় গম চাষ অঞ্চল গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এজন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হতে পারে বলেও তারা জানান।
উত্তরাঞ্চলের শীত দেশের অন্যসব অঞ্চল থেকে দীর্ঘতর হয় এবং শীতের প্রকোপও বেশি। সুতরাং উত্তরাঞ্চল অধিকতর উপযোগী বলে বিবেচিত হতে পারে।
নিবিড় গম চাষ অঞ্চলের চাষিদের হ্রাসকৃত মূল্যে উন্নতমানের গমবীজ ও সার সরবরাহসহ সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের পরামর্শ দেন তারা। উল্লেখ্য, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শস্য উপখাতের জন্য যেসব চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ঋণ প্রাপ্তি অন্যতম।
বিশেষজ্ঞরা উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ব্লাস্ট ও অন্যান্য রোগে গমের উৎপাদন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকেও বিশেষ নজর দেয়ার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
জাহিদ হোসেন বিপ্লব
৩১ মে, ২০২২, 1:26 AM

দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য গমের চাহিদা প্রতিদিন বাড়লেও উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় আমদানি-নির্ভর এই কৃষিপণ্যটির আমদানির পরিমাণ দিনদিন যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি এর পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তাও হয়ে পড়েছে ঝুঁকিপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, শুধু স্থানীয় উৎপাদনের ওপর ভরসা করে সামনের দিনগুলোর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর এক গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে গমের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২১ অনুযায়ী, গমের চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চললেও এর উৎপাদন নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকের তুলনায় ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে।
সরকারি তথ্য মোতাবেক, ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে দেশে গমের উৎপাদন হয়েছিল ১৯ লাখ আট হাজার টন। এটি এ পর্যন্ত বাংলাদেশে গমের সর্বোচ্চ উৎপাদন। এর পর থেকে গমের উৎপাদন কমতে থাকে এবং ২০০৬-০৭ অর্থবছরে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় সাত লাখ ২৫ হাজার টনে (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৯)।
এরপর অবশ্য পণ্যটির উৎপাদন কিছুটা বাড়তে থাকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে গমের উৎপাদন দাঁড়ায় ১২ লাখ ৪৬ হাজার টনে। এর আগের দুই অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১০ লাখ ৯৯ হাজার টন এবং ১১ লাখ ৪৮ হাজার টন। ২০২০-২১ অর্থবসরে গমের উৎপাদন ছিল ১১ লাখ ৬৭ হাজার টন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৭.৩৪ লাখ টন গম আমদানি করে যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরের চেয়ে ৩১লাখ টন বেশি।
এনবিআর তথ্য আরও বলছে, বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৫৫.৫ লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যেও দেখায় যে গত ২২ বছরে দু/এক বছরের ব্যাতিক্রম বাদ দিলে গমের চাষ ও উৎপাদন উভয়ই হ্রাস পেয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমআরএইউ) অধ্যাপক ও উদ্ভিদ জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের প্রধান তোফাজ্জল ইসলাম বলেন, ব্লাস্ট এবং ভয়ঙ্কর ছত্রাকজনিত রোগে ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশে গম চাষ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। সেই সময়ে যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, বরিশাল ও ভোলায় সরকার গম চাষের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যা এখন বহাল আছে।
গমের উৎপাদন কমে যাওয়ার জন্য যেসব কারণকে বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - (১) গম উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ শীতকাল যা একসময় ছিল বাংলাদেশে, কিন্তু এখন আর নেই। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনকে বাংলাদেশে শীতের স্থায়িত্ব কমার জন্য দায়ী করেছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। (২) গমের জমি ভুট্টা, আলু এবং স্বল্পমেয়াদি সব্জি চাষে চলে যাওয়ায় গম চাষের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তা ছাড়া শ্রমিক সংকট, ইঁদুরের উপদ্রব, মাড়াইয়ের সমস্যা এবং ভালো বীজের অভাবের কারনেও গম চাষে চাষিরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। (৩) গমের ব্লাস্ট রোগ বাংলাদেশে গম চাষের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম প্রধান অন্তরায় হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। গমের উৎপাদনশীলতা হ্রাসে এ রোগটির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) পরিসংখ্যাণ অনুসারে দেশে বছরে গমের চাহিদা কম-বেশি ৭০ লাখ টন। আর দেশে উৎপাদিত গমের পরিমাণ ১০ থেকে ১২ লাখ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই দেশে গমের চাহিদা মেটানোর প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে আমদানি।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও)-এর হিসাব মোতাবেক, বিশ্বের যে কয়টি দেশে সবচেয়ে দ্রুত হারে গমের আমদানি বাড়ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
গত কয়েক বছরে গম আমদানির তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশে গমের মোট চাহিদার পাঁচ ভাগের চার ভাগ মেটানো হয়েছে আমদানির মাধ্যমে। ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানি করা গমের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫৬ লাখ ৯ হাজার, ৫৭ লাখ ৭৯ হাজার, ৫৫ লাখ ৩৬ হাজার এবং ৬৩ লাখ ৬৬ হাজার টন (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২১)। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৩ লাখ ৪২ হাজার ৮০০ টন গম আমদানি হয়েছে বলে অন্য এক সূত্রে জানা যায়।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২১ সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে গম আমদানিতে ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে এক হাজার ৪৯৪, এক হাজার ৪৩৬ এবং এক হাজার ৬৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক, ড. দেবাশীষ সরকার বলেন, গত দুই দশক বা তারও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ গমের উৎপাদন বছরে ২০ লাখ টন থেকে হ্রাস পেয়ে মাত্র ১০ লাখ টনে এসে দাঁড়িয়েছে। যেখানে গমের চাহিদা বছরে প্রায় ৭০ লাখ টনে পৌঁছেছে। ফলস্বরূপ, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ দশ গম আমদানিকারক দেশগুলোর একটি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ভারত থেকে ব্যবসায়ীদের আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আপাতত দেশে গমের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মোকাবিলায় গমের মজুত বাড়ানো উচিত।
এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়ানো দরকার। কারণ, রাশিয়া ও ইউক্রেন গমের অন্যতম উৎস। অন্যান্য দেশও এখন বিকল্প উৎস থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করছে। তাতে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বলেন, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো গমের উৎপাদন বৃদ্ধি। মনে রাখতে হবে, দেশে দানাদার খাদ্যশস্য হিসাবে ধানের পরই গমের স্থান। আমাদের প্রথম লক্ষ্য হবে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরের উৎপাদন অবস্থায় ফিরে গিয়ে ২০ লাখ টন গম উৎপাদন করা। এরপর ধীরে ধীরে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা।
এজন্য উষ্ণ আবহাওয়া-সহনশীল জাতের গম উদ্ভাবনের ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি গম উৎপাদন অঞ্চল চিহ্নিত করে নিবিড় গম চাষ অঞ্চল গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এজন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হতে পারে বলেও তারা জানান।
উত্তরাঞ্চলের শীত দেশের অন্যসব অঞ্চল থেকে দীর্ঘতর হয় এবং শীতের প্রকোপও বেশি। সুতরাং উত্তরাঞ্চল অধিকতর উপযোগী বলে বিবেচিত হতে পারে।
নিবিড় গম চাষ অঞ্চলের চাষিদের হ্রাসকৃত মূল্যে উন্নতমানের গমবীজ ও সার সরবরাহসহ সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের পরামর্শ দেন তারা। উল্লেখ্য, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শস্য উপখাতের জন্য যেসব চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ঋণ প্রাপ্তি অন্যতম।
বিশেষজ্ঞরা উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ব্লাস্ট ও অন্যান্য রোগে গমের উৎপাদন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকেও বিশেষ নজর দেয়ার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেছেন।