নারী পাচারে নতুন কৌশল বিয়ে

হরলাল রায় সাগর
২৩ মে, ২০২২, 8:29 PM

নারী পাচারে নতুন কৌশল বিয়ে
যশোরের যুবক মনিরুল ইসলাম মনির। বিয়ে করেছেন এ পর্যন্ত ৭৫টি। তবে কোনো স্ত্রীর সঙ্গেই সংসার করেননি। দরিদ্র-অসহায় পরিবারের এইসব মেয়েদের বিয়ের ফাঁদে ফেলে করে দিতেন বিক্রি। পাচারের পর তাদের ঠাঁই হত যৌনপল্লীতে।
অবৈধভাবে সীমান্ত পার করে কেবল ভারতেই অন্তত দুইশ নারীকে পাচার বা বিক্রি করেছেন মনির। হাতিয়েছেন বিপুল টাকা। ভারতের গুরজরাটে সম্প্রতি মনির গ্রেফতার হওয়ার পর এই তথ্য জানতে পেরেছে দেশটির পুলিশ।
লিটন নামের আরেক পাচারকারী থাকেন বিদেশে। টার্গেট করে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে পরিচিত হতেন। পাশাপাশি তার দেশি সহযোগীরা নারীদের বিদেশে পাঠানোর কথা বলে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতো। এভাবে সখ্য গড়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতেন এবং কখনো টেলিফোনে, আবার কখনো কখনো দেশে এসে সরাসরি বিয়ে করতেন লিটন।
এভাবে তিনি অন্তত ছয়জনকে বিয়ে করেছেন এবং তাদের মধ্যে পাঁচজনকে ইরাকে পাচার করে বিক্রি করে দিয়েছেন। এই লিটন চক্র ৩০-৪০ জন নারীকে পাচার করে মধ্যপাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বিক্রি করেছে বলে জানিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
নানা ধরনের ফাঁদে ফেলে নারীদের বিক্রি-পাচারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এরকম বিয়ে’র ফাঁদ। অভিনব সব কৌশলে পাচারের সঙ্গে তরুণী বউ পাচার এখন আলোচিত ঘটনা। ম্যারেজ মিডিয়া’র আড়ালেও বিয়ের ফাঁদে ফেলে করা হচ্ছে মানব পাচার।
বিয়েকে নারী পাচারের সহজ ফাঁদ হিসেবে দেখছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। এছাড়া চাকরি ও উন্নত জীবনের প্রলোভন এবং মডেলিংয়ের ফাঁদে ফেলে নারী পাচার হর হামেশা ঘটছেই। মাজার থেকেও নানা লোভ দেখিয়ে তরুণীদের বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে বাইরের দেশের যৌনপল্লীতে।
সম্প্রতি দুইশ’ জন নারীকে ভারতে পাচারের অভিযোগে গুজরাটের সুরাট থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে বাংলাদেশের যশোরের মনিরুল ইসলাম মনির। আটকের পর মনির স্বীকার করে, বাংলাদেশের দরিদ্র মেয়েদের বিয়ে করে তাদের পাচার করাই তার পেশা। পাচারের উদ্দেশ্যে মনির বিয়ে করেন ৭৫টি। বিয়ের পর স্ত্রীদের অবৈধভাবে সীমান্ত পার করে নিয়ে যেতো কলকাতায়। তারপর তাদের বিক্রি করে দিতে ভারতের বিভিন্ন যৌনপল্লীতে।
শুধু যে বাঙালি নারীরাই এই পাচারের শিকার হচ্ছেন, তা নয়। আদিবাসী নারীরাও বিভিন্নভাবে পাচার হচ্ছেন। এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫ বছরে প্রায় ৪৫০ জন আদিবাসী নারী পাচারের শিকার হয়েছেন। এই্ পাচারের সঙ্গে ১০টি ম্যারেজ মিডিয়ার সম্পৃক্ততাও খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
জানা গেছে, এই ধরনের ম্যারেজ মিডিয়ার মাধ্যমে প্রাথমিক যোগাযোগের পর চীনা নাগরিকরা বাংলাদেশে এসে বিয়ের পর চীনে নিয়ে যাওয়ার কয়েক মাস পরই তাদেরকে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে সেখানকার বিভিন্ন যৌন ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসি মেয়েরাই এই ধরনের পাচারের শিকার হচ্ছেন।
শুধু বিয়ের প্রলোভনই নয় টিকটকের তারকা বানানোর প্রলোভন দেখিয়েও ভারতে পাচার করা হয়েছে অনেক নারীকে। এ ধরনের প্রলোভনে পড়ে পাচারের শিকার ঢাকার এক তরুণী ভারত থেকে ফিরে বীভৎস নির্যাতনের তথ্য দেয় পুলিশের কাছে। তাকে বিবস্ত্র করে শারীরিক নির্যাতনের পর দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়। পরে নির্যাতন ও ভিডিওর ওই দৃশ্য ভাইরাল হয়। ওই তরুণীকে পাচারের সমন্বয়ক ছিল ঢাকার হৃদয় বাবু ওরফে টিকটক হৃদয় (মোহাম্মদ রিফাকদুল ইসলাম) নামক এক যুবক। এই চক্রের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার নারী পাচারের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। এই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ভারতের বেঙ্গালুরুর এক আদালত শনিবার দেশটিতে গ্রেফতার হওয়া ১১ বাংলাদেশিসহ ১২জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে।
প্রেম করে বিয়ের পর ভারতে পাচারের শিকার হন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার এক তরুণী। তিনি পাটগ্রাম থানা পুলিশকে জানিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ৩ বছর আগে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার বেতাপুর গ্রামের কিবরিয়ার পুত্র সোহেলের সঙ্গে পরিচয় ও প্রেম হয়। এরপর তারা অবৈধভাবে সাতক্ষিীরা সীমান্ত দিয়ে কলকাতা যান। সেখানে বেশ কিছু দিন তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তারা দেশে ফিরেন।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জ আদালতে সোহেল ও ওই তরুণী বিয়ে করেন। কিন্তু সোহেল পাচারকারী চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাটগ্রামে পাঠিয়ে দেন। ১৩ মে ভোরে পাচারকারীরা তাকে ওই উপজেলার দহগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করে দেয়। ভারতে প্রবেশের পর বুঝতে পারেন তার স্বামী তাকে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। ১৫ মে রাতে দহগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ফিরে আসেন তরুণী। ভারতে পাচারকালে ও দেশে ফিরে আসার পর ওই পাচার দলের সদস্য মোকছেদুল ও আশরাফুল ইসলাম তাকে ধর্ষণ করেন বলে অভিযোগ করেন তরুণী। পাচার দলের বন্দিদশা থেকে কৌশলে পালিয়ে পাটগ্রাম থানায় আশ্রয় তিনি।
পাটগ্রাম থানার ওসি ওমর ফারুক জানান, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ গতকাল রোববার ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার মূলহোতা প্রেমিক থেকে স্বামী হওয়া সোহেলকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশ থেকে কত নারী প্রতিবছর পাচার হয় সে বিষয়ে সরকারিভাবে খুব বেশি তথ্য নেই। তবে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৮টি রুট দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার নারী, শিশু ও কিশোরী ভারতে পাচার হচ্ছে। আবার অনেক এনজিও’র মতে বিগত দশ বছরে ভারতে অথবা ভারত হয়ে অন্য দেশে কমপক্ষে ৫০ হাজার বাংলাদেশি নারী পাচার হয়েছেন।
বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত তথ্য মতে, বাংলাদেশের নারীরা দুবাই, আবুধাবি, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীনসহ বিভিন্ন দেশেই কম-বেশি পাচার হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি পাচার হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থাকা পাচারকারী সিন্ডিকেট চাকরিসহ নানা লোভ দেখিয়ে ২০-৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে নারীদের বিক্রি করে দিচ্ছে ভারতীয় সিন্ডিকেটের কাছে। সেখানে আবার নানা হাত ঘুরে অনেকেরই ঠিকানা হচ্ছে যৌন পল্লীতে।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ও রাইটস যশোর নামের দুই বেসরকারি সংস্থার তথ্য থেকে জানা যায়, ভারতে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর ভারতের সরকারি ও বেসরকারি সেফহোমে এখনো ৫০ জনের বেশি বাংলাদেশি নারী রয়েছেন। তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি জানায় যে, বিগত ১০ বছরে ভারতে পাচার হওয়া ২ হাজার নারীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
এদিকে পাচারের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধারের পর ভিকটিমকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো আরও বেশী জটিল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা-ভিত্তিক উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা ডি-নেটের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর সংকলিতা সোম বলেন, ভারত থেকে বাংলাদেশে যখন একজন ভিক্টিমকে ফেরত পাঠানো হয়, তখন তাকে উদ্ধার করা থেকে শুরু করে নিজের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত অন্তত ৭২টা ধাপ জড়িত এবং দুই দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও নানা এনজিও ইত্যাদি মিলে মোট ২২টি ‘স্টেকহোল্ডার’ এই গোটা প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত।
বাংলাদেশ থেকে নারীরা কোন পটভূমি থেকে, কীভাবে পাচার হয়ে ভারতে আসছেন তা নিয়ে সমীক্ষা করেছেন ভারতের বাংলানাটক ডটকমের অ্যাক্টিভিস্ট অনন্যা ভট্টাচার্য। তিনি বলছেন, পাচার কিন্তু শুধু সীমান্ত এলাকা থেকেই নয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরের জেলাগুলো থেকেও হচ্ছে। আর বিশেষ করে প্রান্তিক পরিবারগুলোর সদস্যরা, যেমন বিধবা মহিলা বা এতিম শিশুরাই এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভালনারেবল, তারাই বেশি পাচার হচ্ছেন।
অনন্যা ভট্টাচার্য তার সমীক্ষায় আরও দেখেছেন, বায়রা’র মতো সংস্থার অধীনে বাংলাদেশে যে অসংখ্য লেবার রিক্রুটমেন্ট সংস্থা কাজ করছে তাদেরও অনেকেই বিদেশে ভাল চাকরির লোভ দেখিয়ে, অনেক টাকা নিয়ে তারপর তাদের শোষণের পথ করে দিচ্ছেন।
ঢাকা ডি-নেটের সংকলিতা সোম বলেন, যশোর-সাতক্ষীরার মতো সীমান্ত শহরে ‘ট্রানজিট হাউস’গুলো পাচারের কাজে ব্যবহার করা হয় ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় সব জেলা থেকেই পাচারের ঘটনা ঘটে। আরও যেটা করুণ ব্যাপার, এদের অনেকেই ঘরবাড়ি ছাড়েন স্বেচ্ছায় চরম দারিদ্র থেকে মুক্তি পেয়ে উন্নত জীবনের আশায়। কিন্তু নারীদের বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুম্বাই বা দিল্লির রেড লাইট এরিয়াতে বেচে দেওয়ার ঘটনা ঘটে অহরহ।
জানা যায়, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে মানব-পাচার রোধে গত বছরই স্বাক্ষরিত হয়েছে একটি সমঝোতাপত্র (এমওইউ)। কিন্তু বাস্তবে এই সমস্যার মোকাবিলায় খুব একটা অগ্রগতি হয়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
হরলাল রায় সাগর
২৩ মে, ২০২২, 8:29 PM

যশোরের যুবক মনিরুল ইসলাম মনির। বিয়ে করেছেন এ পর্যন্ত ৭৫টি। তবে কোনো স্ত্রীর সঙ্গেই সংসার করেননি। দরিদ্র-অসহায় পরিবারের এইসব মেয়েদের বিয়ের ফাঁদে ফেলে করে দিতেন বিক্রি। পাচারের পর তাদের ঠাঁই হত যৌনপল্লীতে।
অবৈধভাবে সীমান্ত পার করে কেবল ভারতেই অন্তত দুইশ নারীকে পাচার বা বিক্রি করেছেন মনির। হাতিয়েছেন বিপুল টাকা। ভারতের গুরজরাটে সম্প্রতি মনির গ্রেফতার হওয়ার পর এই তথ্য জানতে পেরেছে দেশটির পুলিশ।
লিটন নামের আরেক পাচারকারী থাকেন বিদেশে। টার্গেট করে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে পরিচিত হতেন। পাশাপাশি তার দেশি সহযোগীরা নারীদের বিদেশে পাঠানোর কথা বলে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতো। এভাবে সখ্য গড়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতেন এবং কখনো টেলিফোনে, আবার কখনো কখনো দেশে এসে সরাসরি বিয়ে করতেন লিটন।
এভাবে তিনি অন্তত ছয়জনকে বিয়ে করেছেন এবং তাদের মধ্যে পাঁচজনকে ইরাকে পাচার করে বিক্রি করে দিয়েছেন। এই লিটন চক্র ৩০-৪০ জন নারীকে পাচার করে মধ্যপাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বিক্রি করেছে বলে জানিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
নানা ধরনের ফাঁদে ফেলে নারীদের বিক্রি-পাচারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এরকম বিয়ে’র ফাঁদ। অভিনব সব কৌশলে পাচারের সঙ্গে তরুণী বউ পাচার এখন আলোচিত ঘটনা। ম্যারেজ মিডিয়া’র আড়ালেও বিয়ের ফাঁদে ফেলে করা হচ্ছে মানব পাচার।
বিয়েকে নারী পাচারের সহজ ফাঁদ হিসেবে দেখছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। এছাড়া চাকরি ও উন্নত জীবনের প্রলোভন এবং মডেলিংয়ের ফাঁদে ফেলে নারী পাচার হর হামেশা ঘটছেই। মাজার থেকেও নানা লোভ দেখিয়ে তরুণীদের বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে বাইরের দেশের যৌনপল্লীতে।
সম্প্রতি দুইশ’ জন নারীকে ভারতে পাচারের অভিযোগে গুজরাটের সুরাট থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে বাংলাদেশের যশোরের মনিরুল ইসলাম মনির। আটকের পর মনির স্বীকার করে, বাংলাদেশের দরিদ্র মেয়েদের বিয়ে করে তাদের পাচার করাই তার পেশা। পাচারের উদ্দেশ্যে মনির বিয়ে করেন ৭৫টি। বিয়ের পর স্ত্রীদের অবৈধভাবে সীমান্ত পার করে নিয়ে যেতো কলকাতায়। তারপর তাদের বিক্রি করে দিতে ভারতের বিভিন্ন যৌনপল্লীতে।
শুধু যে বাঙালি নারীরাই এই পাচারের শিকার হচ্ছেন, তা নয়। আদিবাসী নারীরাও বিভিন্নভাবে পাচার হচ্ছেন। এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫ বছরে প্রায় ৪৫০ জন আদিবাসী নারী পাচারের শিকার হয়েছেন। এই্ পাচারের সঙ্গে ১০টি ম্যারেজ মিডিয়ার সম্পৃক্ততাও খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
জানা গেছে, এই ধরনের ম্যারেজ মিডিয়ার মাধ্যমে প্রাথমিক যোগাযোগের পর চীনা নাগরিকরা বাংলাদেশে এসে বিয়ের পর চীনে নিয়ে যাওয়ার কয়েক মাস পরই তাদেরকে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে সেখানকার বিভিন্ন যৌন ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসি মেয়েরাই এই ধরনের পাচারের শিকার হচ্ছেন।
শুধু বিয়ের প্রলোভনই নয় টিকটকের তারকা বানানোর প্রলোভন দেখিয়েও ভারতে পাচার করা হয়েছে অনেক নারীকে। এ ধরনের প্রলোভনে পড়ে পাচারের শিকার ঢাকার এক তরুণী ভারত থেকে ফিরে বীভৎস নির্যাতনের তথ্য দেয় পুলিশের কাছে। তাকে বিবস্ত্র করে শারীরিক নির্যাতনের পর দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়। পরে নির্যাতন ও ভিডিওর ওই দৃশ্য ভাইরাল হয়। ওই তরুণীকে পাচারের সমন্বয়ক ছিল ঢাকার হৃদয় বাবু ওরফে টিকটক হৃদয় (মোহাম্মদ রিফাকদুল ইসলাম) নামক এক যুবক। এই চক্রের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার নারী পাচারের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। এই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ভারতের বেঙ্গালুরুর এক আদালত শনিবার দেশটিতে গ্রেফতার হওয়া ১১ বাংলাদেশিসহ ১২জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে।
প্রেম করে বিয়ের পর ভারতে পাচারের শিকার হন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার এক তরুণী। তিনি পাটগ্রাম থানা পুলিশকে জানিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ৩ বছর আগে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার বেতাপুর গ্রামের কিবরিয়ার পুত্র সোহেলের সঙ্গে পরিচয় ও প্রেম হয়। এরপর তারা অবৈধভাবে সাতক্ষিীরা সীমান্ত দিয়ে কলকাতা যান। সেখানে বেশ কিছু দিন তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তারা দেশে ফিরেন।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জ আদালতে সোহেল ও ওই তরুণী বিয়ে করেন। কিন্তু সোহেল পাচারকারী চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাটগ্রামে পাঠিয়ে দেন। ১৩ মে ভোরে পাচারকারীরা তাকে ওই উপজেলার দহগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করে দেয়। ভারতে প্রবেশের পর বুঝতে পারেন তার স্বামী তাকে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। ১৫ মে রাতে দহগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ফিরে আসেন তরুণী। ভারতে পাচারকালে ও দেশে ফিরে আসার পর ওই পাচার দলের সদস্য মোকছেদুল ও আশরাফুল ইসলাম তাকে ধর্ষণ করেন বলে অভিযোগ করেন তরুণী। পাচার দলের বন্দিদশা থেকে কৌশলে পালিয়ে পাটগ্রাম থানায় আশ্রয় তিনি।
পাটগ্রাম থানার ওসি ওমর ফারুক জানান, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ গতকাল রোববার ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার মূলহোতা প্রেমিক থেকে স্বামী হওয়া সোহেলকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশ থেকে কত নারী প্রতিবছর পাচার হয় সে বিষয়ে সরকারিভাবে খুব বেশি তথ্য নেই। তবে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৮টি রুট দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার নারী, শিশু ও কিশোরী ভারতে পাচার হচ্ছে। আবার অনেক এনজিও’র মতে বিগত দশ বছরে ভারতে অথবা ভারত হয়ে অন্য দেশে কমপক্ষে ৫০ হাজার বাংলাদেশি নারী পাচার হয়েছেন।
বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত তথ্য মতে, বাংলাদেশের নারীরা দুবাই, আবুধাবি, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীনসহ বিভিন্ন দেশেই কম-বেশি পাচার হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি পাচার হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থাকা পাচারকারী সিন্ডিকেট চাকরিসহ নানা লোভ দেখিয়ে ২০-৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে নারীদের বিক্রি করে দিচ্ছে ভারতীয় সিন্ডিকেটের কাছে। সেখানে আবার নানা হাত ঘুরে অনেকেরই ঠিকানা হচ্ছে যৌন পল্লীতে।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ও রাইটস যশোর নামের দুই বেসরকারি সংস্থার তথ্য থেকে জানা যায়, ভারতে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর ভারতের সরকারি ও বেসরকারি সেফহোমে এখনো ৫০ জনের বেশি বাংলাদেশি নারী রয়েছেন। তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি জানায় যে, বিগত ১০ বছরে ভারতে পাচার হওয়া ২ হাজার নারীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
এদিকে পাচারের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধারের পর ভিকটিমকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো আরও বেশী জটিল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা-ভিত্তিক উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা ডি-নেটের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর সংকলিতা সোম বলেন, ভারত থেকে বাংলাদেশে যখন একজন ভিক্টিমকে ফেরত পাঠানো হয়, তখন তাকে উদ্ধার করা থেকে শুরু করে নিজের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত অন্তত ৭২টা ধাপ জড়িত এবং দুই দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও নানা এনজিও ইত্যাদি মিলে মোট ২২টি ‘স্টেকহোল্ডার’ এই গোটা প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত।
বাংলাদেশ থেকে নারীরা কোন পটভূমি থেকে, কীভাবে পাচার হয়ে ভারতে আসছেন তা নিয়ে সমীক্ষা করেছেন ভারতের বাংলানাটক ডটকমের অ্যাক্টিভিস্ট অনন্যা ভট্টাচার্য। তিনি বলছেন, পাচার কিন্তু শুধু সীমান্ত এলাকা থেকেই নয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরের জেলাগুলো থেকেও হচ্ছে। আর বিশেষ করে প্রান্তিক পরিবারগুলোর সদস্যরা, যেমন বিধবা মহিলা বা এতিম শিশুরাই এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভালনারেবল, তারাই বেশি পাচার হচ্ছেন।
অনন্যা ভট্টাচার্য তার সমীক্ষায় আরও দেখেছেন, বায়রা’র মতো সংস্থার অধীনে বাংলাদেশে যে অসংখ্য লেবার রিক্রুটমেন্ট সংস্থা কাজ করছে তাদেরও অনেকেই বিদেশে ভাল চাকরির লোভ দেখিয়ে, অনেক টাকা নিয়ে তারপর তাদের শোষণের পথ করে দিচ্ছেন।
ঢাকা ডি-নেটের সংকলিতা সোম বলেন, যশোর-সাতক্ষীরার মতো সীমান্ত শহরে ‘ট্রানজিট হাউস’গুলো পাচারের কাজে ব্যবহার করা হয় ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় সব জেলা থেকেই পাচারের ঘটনা ঘটে। আরও যেটা করুণ ব্যাপার, এদের অনেকেই ঘরবাড়ি ছাড়েন স্বেচ্ছায় চরম দারিদ্র থেকে মুক্তি পেয়ে উন্নত জীবনের আশায়। কিন্তু নারীদের বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুম্বাই বা দিল্লির রেড লাইট এরিয়াতে বেচে দেওয়ার ঘটনা ঘটে অহরহ।
জানা যায়, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে মানব-পাচার রোধে গত বছরই স্বাক্ষরিত হয়েছে একটি সমঝোতাপত্র (এমওইউ)। কিন্তু বাস্তবে এই সমস্যার মোকাবিলায় খুব একটা অগ্রগতি হয়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।