সেতুতে সেতুবন্ধন বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ

জাহিদ হোসেন বিপ্লব
২৫ জুন, ২০২২, 1:20 AM

সেতুতে সেতুবন্ধন বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ
প্রমত্ত পদ্মার বুকে সেতুর স্বপ্ন এখন আর স্বপ্ন নয়। পদ্মার বুকে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একসময়ের স্বপ্নের সেতু এখন দৃষ্টিসীমায় দিগন্ত জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। নির্মিত সেতুটি নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
যদিও শুরুতে ছিল প্রতিবন্ধকতা, ছিল সীমাবদ্ধতা। ষড়যন্ত্রেরও কমতি ছিল না। কিন্তু সব বাধা জয় করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন বাস্তব। নিজ অর্থে বিশাল এ সেতু বানিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে বাংলাদেশ। স্বপ্নিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণের ইতি আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে আজ উদ্বোধন করবেন পদ্মা সেতুর। পরদিন রবিবার ভোর ৬টা থেকে যান চলাচলের জন্য এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। ওইদিন থেকেই সারা দেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশ এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হতে পারবে। গড়ে উঠবে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড)। পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। সারাদেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
দ্বি-স্তরের ইস্পাত ট্রাস সেতুটির উপরের স্তরে একটি চার লেনের মহাসড়ক এবং নীচের স্তরে একটি একক-ট্র্যাক রেলপথ থাকবে।
করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলেও সেতুটির নির্মাণ কাজ পুরোদমে চলছিল। শেখ হাসিনার অদম্য ইচ্ছা শক্তির কারণে সেতুর কাজ একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। করোনা মোকাবিলায় পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়েছে। সবাই যখন দেখলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেতুর কাজ এগিয়ে যাচ্ছে তখন কিছু অসাধু ও ষড়যন্ত্রকারী গুজব ছড়াতে থাকে।
গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে সেতু তৈরি করতে মানুষের মাথা লাগবে। সরকারও দক্ষতার সঙ্গে তা মোকাবেলা করেছে। শেখ হাসিনার অদম্য ইচ্ছা শক্তিতে শুধু পদ্মা সেতুই নয়, মেট্রোরেল ও দেশের বৃহত্তম টানেলের কাজও প্রায় শেষের দিকে। সে গুলো এ বছর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। একই সঙ্গে অনেক মেগা প্রকল্পের কাজও চলছে।
মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্ট এবং শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টের সাথে সংযোগকারী বাংলাদেশের একটি স্বপ্নের প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতু, যা যাত্রী ও মালবাহী যানবাহনের জন্য যাত্রা সহজ করবে এবং ধীরে ধীরে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ৩ থেকে ২ শতাংশ বাড়িয়ে দিবে।
ক্ষমতাসীনরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ থেকে ১.৫ শতাংশ। এর প্রভাবে পাল্টে যাবে দেশের সার্বিক চিত্র। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেতু শুধু চালু হলেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে না। সেতুর দুই পাড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। যাতে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যত বেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে জিডিপিতে এর অবদান তত পড়বে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি প্রকল্প, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ, পায়রা সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরী নির্মাণসহ অনেক প্রকল্প উল্লেখযোগ্য। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতু নয়; এটা দেশের একটি বড় সম্পদ। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল উত্তর-পূর্ব অংশের সঙ্গে যুক্ত হবে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৮ দশমিক ১০ মিটার চওড়া সেতুটির নির্মাণ কাজ ৭ ডিসেম্বর, ২০১৪ তারিখে শুরু হয়।
বিশ্বব্যাংক ২০১২ সালে হঠাৎ পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিল করে যা ১৬ কোটি বাঙালির জন্য ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। কিছু সুনির্দিষ্ট লোকের স্বার্থের জন্য বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মি. জোয়েলিককে তার শেষ কর্মদিবসে ১২০ কোটি ডলারের অর্থায়ন বাতিলে প্রলুব্ধ করে। একে একে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় জাইকা, এডিবি ও আইডিবির মতো দাতা সংস্থাগুলোও।
পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য যেখানে দাতা সংস্থাগুলো অনুদানই করেনি, সেখানে উল্টো দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০১৯ সালে পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়িয়ে ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করা হয়। কোনো অলীক কল্পনা বা স্বপ্ন নয়। কোনো ষড়যন্ত্রই টেকেনি জনগণের টাকায় নির্মিত এ স্থাপনা নির্মাণে। যার নতুন যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালের মে মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় ঘোষণার মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতু হবে আমাদের নিজের টাকায়। আর গত ৪ জুন পদ্মা সেতুতে জ্বলে ওঠে স্ট্রিটলাইট। এ যেন অমাবস্যা পেরিয়ে পূর্ণিমার আলো।
পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন দিকে মোড় নেবে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য অর্থনীতি বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠানসমূহ করতে শুরু করেছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার পর আগামী ৩০ বছরের মধ্যে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ৬ হাজার বিলিয়ন ডলার এবং ২০৩০ সালেই তার বাৎসরিক রিটার্ন দাঁড়াবে ৩০০ মিলিয়ন ডলার।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘পদ্মা সেতুর ফলে আমাদের ভৌগোলিক বিভাজন যেটা ছিল, সেটা দূর হবে। বাংলাদেশ একটা একীভূত অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হবে। পদ্মা সেতুর ফলে আমাদের বিনিয়োগ, বিতরণ, বিপণন ব্যবস্থা আরও সাশ্রয়ী হবে। এগুলো আমাদের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এছাড়া ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু ঘিরে বিনিয়োগের বিভিন্ন সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। এসব বিনিয়োগ নানামুখী কর্মসংস্থান তৈরি করবে এবং দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলে আমরা মনে করছি।’
‘পদ্মা সেতুর সঙ্গে সঙ্গে যেগুলো হওয়ার কথা; বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক— এগুলোও হতে হবে। এজন্য আমাদের দক্ষ জনশক্তি প্রস্তুত করতে হবে। সুতরাং সেতু খোলার পরবর্তীতে যে কাজগুলো করার কথা সেগুলো করতে পারলে সম্ভাব্য জিডিপিতে যে অবদান সেটা অনেক বেশি হবে। সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী ১.২ প্রবৃদ্ধি বাড়বে। তবে এটা বেশিও হতে পারে।’
যদি আমরা অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারি তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হবে। তবে, এটা অটোমেটিক্যালি (স্বয়ংক্রিয়ভাবে) হবে না। পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিনিয়োগ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, পর্যটন খাতের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে হবে— বলেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে নিঃসন্দেহে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে মাত্রাটা কী পরিমাণে হবে সেটার বিষয়ে আমি এখন বলতে পারব না। ‘এখন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কাঁচামাল ও শ্রমিকদের ওপর নির্ভর— এমন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে পারে সরকার। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও বাড়বে। যার প্রভাব দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপর পড়বে। সবমিলিয়ে আমি মনে করি, পদ্মা সেতু অত্যন্ত ইতিবাচক হবে আমাদের জন্য।’
অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল আরো বলেন, ‘আমার পক্ষে জিডিপির ফিগার এই মুহূর্তে বলা সম্ভব না। তবে, বিশেষজ্ঞদের ঘোষণা আমার কাছে বাস্তব বলেই মনে হয়। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত ও যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার মধ্যে দিয়ে বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে এবং জাতির আস্থাকেও ত্বরান্বিত করেছে।
জাহিদ হোসেন বিপ্লব
২৫ জুন, ২০২২, 1:20 AM

প্রমত্ত পদ্মার বুকে সেতুর স্বপ্ন এখন আর স্বপ্ন নয়। পদ্মার বুকে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একসময়ের স্বপ্নের সেতু এখন দৃষ্টিসীমায় দিগন্ত জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। নির্মিত সেতুটি নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
যদিও শুরুতে ছিল প্রতিবন্ধকতা, ছিল সীমাবদ্ধতা। ষড়যন্ত্রেরও কমতি ছিল না। কিন্তু সব বাধা জয় করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন বাস্তব। নিজ অর্থে বিশাল এ সেতু বানিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে বাংলাদেশ। স্বপ্নিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণের ইতি আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে আজ উদ্বোধন করবেন পদ্মা সেতুর। পরদিন রবিবার ভোর ৬টা থেকে যান চলাচলের জন্য এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। ওইদিন থেকেই সারা দেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশ এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হতে পারবে। গড়ে উঠবে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড)। পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। সারাদেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
দ্বি-স্তরের ইস্পাত ট্রাস সেতুটির উপরের স্তরে একটি চার লেনের মহাসড়ক এবং নীচের স্তরে একটি একক-ট্র্যাক রেলপথ থাকবে।
করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলেও সেতুটির নির্মাণ কাজ পুরোদমে চলছিল। শেখ হাসিনার অদম্য ইচ্ছা শক্তির কারণে সেতুর কাজ একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। করোনা মোকাবিলায় পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়েছে। সবাই যখন দেখলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেতুর কাজ এগিয়ে যাচ্ছে তখন কিছু অসাধু ও ষড়যন্ত্রকারী গুজব ছড়াতে থাকে।
গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে সেতু তৈরি করতে মানুষের মাথা লাগবে। সরকারও দক্ষতার সঙ্গে তা মোকাবেলা করেছে। শেখ হাসিনার অদম্য ইচ্ছা শক্তিতে শুধু পদ্মা সেতুই নয়, মেট্রোরেল ও দেশের বৃহত্তম টানেলের কাজও প্রায় শেষের দিকে। সে গুলো এ বছর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। একই সঙ্গে অনেক মেগা প্রকল্পের কাজও চলছে।
মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্ট এবং শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টের সাথে সংযোগকারী বাংলাদেশের একটি স্বপ্নের প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতু, যা যাত্রী ও মালবাহী যানবাহনের জন্য যাত্রা সহজ করবে এবং ধীরে ধীরে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ৩ থেকে ২ শতাংশ বাড়িয়ে দিবে।
ক্ষমতাসীনরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ থেকে ১.৫ শতাংশ। এর প্রভাবে পাল্টে যাবে দেশের সার্বিক চিত্র। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেতু শুধু চালু হলেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে না। সেতুর দুই পাড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। যাতে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যত বেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে জিডিপিতে এর অবদান তত পড়বে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি প্রকল্প, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ, পায়রা সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরী নির্মাণসহ অনেক প্রকল্প উল্লেখযোগ্য। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতু নয়; এটা দেশের একটি বড় সম্পদ। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল উত্তর-পূর্ব অংশের সঙ্গে যুক্ত হবে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৮ দশমিক ১০ মিটার চওড়া সেতুটির নির্মাণ কাজ ৭ ডিসেম্বর, ২০১৪ তারিখে শুরু হয়।
বিশ্বব্যাংক ২০১২ সালে হঠাৎ পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিল করে যা ১৬ কোটি বাঙালির জন্য ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। কিছু সুনির্দিষ্ট লোকের স্বার্থের জন্য বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মি. জোয়েলিককে তার শেষ কর্মদিবসে ১২০ কোটি ডলারের অর্থায়ন বাতিলে প্রলুব্ধ করে। একে একে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় জাইকা, এডিবি ও আইডিবির মতো দাতা সংস্থাগুলোও।
পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য যেখানে দাতা সংস্থাগুলো অনুদানই করেনি, সেখানে উল্টো দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০১৯ সালে পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়িয়ে ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করা হয়। কোনো অলীক কল্পনা বা স্বপ্ন নয়। কোনো ষড়যন্ত্রই টেকেনি জনগণের টাকায় নির্মিত এ স্থাপনা নির্মাণে। যার নতুন যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালের মে মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় ঘোষণার মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতু হবে আমাদের নিজের টাকায়। আর গত ৪ জুন পদ্মা সেতুতে জ্বলে ওঠে স্ট্রিটলাইট। এ যেন অমাবস্যা পেরিয়ে পূর্ণিমার আলো।
পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন দিকে মোড় নেবে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য অর্থনীতি বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠানসমূহ করতে শুরু করেছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার পর আগামী ৩০ বছরের মধ্যে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ৬ হাজার বিলিয়ন ডলার এবং ২০৩০ সালেই তার বাৎসরিক রিটার্ন দাঁড়াবে ৩০০ মিলিয়ন ডলার।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘পদ্মা সেতুর ফলে আমাদের ভৌগোলিক বিভাজন যেটা ছিল, সেটা দূর হবে। বাংলাদেশ একটা একীভূত অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হবে। পদ্মা সেতুর ফলে আমাদের বিনিয়োগ, বিতরণ, বিপণন ব্যবস্থা আরও সাশ্রয়ী হবে। এগুলো আমাদের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এছাড়া ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু ঘিরে বিনিয়োগের বিভিন্ন সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। এসব বিনিয়োগ নানামুখী কর্মসংস্থান তৈরি করবে এবং দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলে আমরা মনে করছি।’
‘পদ্মা সেতুর সঙ্গে সঙ্গে যেগুলো হওয়ার কথা; বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক— এগুলোও হতে হবে। এজন্য আমাদের দক্ষ জনশক্তি প্রস্তুত করতে হবে। সুতরাং সেতু খোলার পরবর্তীতে যে কাজগুলো করার কথা সেগুলো করতে পারলে সম্ভাব্য জিডিপিতে যে অবদান সেটা অনেক বেশি হবে। সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী ১.২ প্রবৃদ্ধি বাড়বে। তবে এটা বেশিও হতে পারে।’
যদি আমরা অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারি তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হবে। তবে, এটা অটোমেটিক্যালি (স্বয়ংক্রিয়ভাবে) হবে না। পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিনিয়োগ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, পর্যটন খাতের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে হবে— বলেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে নিঃসন্দেহে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে মাত্রাটা কী পরিমাণে হবে সেটার বিষয়ে আমি এখন বলতে পারব না। ‘এখন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কাঁচামাল ও শ্রমিকদের ওপর নির্ভর— এমন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে পারে সরকার। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও বাড়বে। যার প্রভাব দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপর পড়বে। সবমিলিয়ে আমি মনে করি, পদ্মা সেতু অত্যন্ত ইতিবাচক হবে আমাদের জন্য।’
অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল আরো বলেন, ‘আমার পক্ষে জিডিপির ফিগার এই মুহূর্তে বলা সম্ভব না। তবে, বিশেষজ্ঞদের ঘোষণা আমার কাছে বাস্তব বলেই মনে হয়। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত ও যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার মধ্যে দিয়ে বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে এবং জাতির আস্থাকেও ত্বরান্বিত করেছে।