বঙ্গবন্ধু টানেল  :  মার্চে দৈনিক গাড়ি চলাচল নেমে এসেছে অনেক নিচে

#
news image

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে যান চলাচল শুরু হয় গত বছরের ২৯ অক্টোবর। শুরুতে দৈনিক পাঁচ হাজারের অধিক গাড়ি চলাচল করত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচলের হার কমেছে। চলতি মার্চে টানেল দিয়ে পার হওয়া দৈনিক গাড়ির সংখ্যা নেমে এসেছে আড়াই হাজারের নিচে। এর উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রামজুড়ে। সম্প্রতি শহরে যানজট তীব্র হয়েছে। এর পেছনে টানেলের সংযোগ ও ব্যবস্থাপনার অভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) তথ্যে জানা গেছে, উদ্বোধনের পর প্রথম কয়েক মাস টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল ক্রমেই বাড়ছিল। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হলেও প্রতি মাসে টানেল দেখতে আসা পর্যটক, কক্সবাজারমুখী যানবাহনের চাপ বাড়তে থাকে। তবে চলতি মাসে টানেল ঘিরে যানবাহনের চাপ অস্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে গেছে। কক্সবাজারমুখী পর্যটকবাহী যানবাহনের চাপ না থাকায় টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল কমেছে বলে জানিয়েছে টানেল কর্তৃপক্ষ। তবে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় তীব্র যানজট তৈরি হয়েছে।

সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ফেব্রুয়ারিতে প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার ৯৪২টি করে যানবাহন টানেল ব্যবহার করেছে। তবে প্রথম থেকে ১২তম রমজানে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল করেছে গড়ে ২ হাজার ২৭৩টি। তার আগে গত বছরের অক্টোবরে যানবাহন চলাচলের গড় ছিল ৫ হাজার ৬৩৬টি, নভেম্বরে ৫ হাজার ৫৪৪, ডিসেম্বরে ৬ হাজার ২৭৩, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪ হাজার ৯০ এবং ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক যানবাহন চলাচলের গড় ছিল ৪ হাজার ৯৪২টি।

টানেল কর্তৃপক্ষ জানায়, টানেল দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের সিংহভাগ ছিল পর্যটক। টানেল দেখতে আসা বা পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে আসা মানুষ বিশেষ ব্যবস্থাপনায় যানবাহন নিয়ে টানেলে প্রবেশ করত। কিন্তু রোজার মাসে পর্যটকের আনাগোনা কমে যাওয়ায় টানেলে যানবাহনের সংখ্যা কমেছে। ঈদের পর থেকে যানবাহনের হার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে বলে আশা করছেন টানেল ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা।

বিবিএ সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের ফলে চট্টগ্রামের যানজট নিরসন ছাড়াও দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী যানবাহনের আধিক্য থাকবে বলে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা ছিল। বলা হয়েছিল উদ্বোধনের পর এ টানেল দিয়ে দৈনিক ১৭ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করবে। এছাড়া ২০২৮ সালে টানেল দিয়ে দৈনিক ২৮ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করবে। এ বিষয়ে বিবিএর দাবি, উভয় পাশে সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া টানেলের বহুমুখী ব্যবহার বাড়াতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থা নানামুখী অবকাঠামো নির্মাণ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। টানেল বাণিজ্যিকভাবে চালু হলেও এসব সংস্থার কাজ এখনো শুরু হয়নি।

জানতে চাইলে বিবিএর প্রধান প্রকৌশলী ও পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) কাজী মো. ফেরদাউস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌টানেল নির্মাণ প্রকল্পের সামগ্রিক ভৌতকাজ শেষ হয়েছে। এখন টানেলকে ঘিরে যানবাহন চলাচল উৎসাহিত করার কাজ স্থানীয় সরকারি সংস্থার। আমরা সংযোগ সড়ক নির্মাণ, টানেল ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছি। সিডিএ, সওজসহ বিভিন্ন সংস্থার নেয়া অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ হলে টানেলটি চট্টগ্রামের যানজট নিরসনসহ নানামুখী কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

অংশীজনরা জানান, চট্টগ্রামের যানজট নিরসনে অন্যতম অবকাঠামো হওয়ার কথা বঙ্গবন্ধু টানেল। চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ অংশের সাতটি উপজেলা, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার দূরপাল্লার যানবাহনগুলো চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ না করে টানেল দিয়ে পারাপার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে কক্সবাজারের পেকুয়া, চকরিয়া, কুতুবদিয়া ও মহেশখালীসহ কয়েকটি উপজেলার যানবাহন সীমিত পরিসরে টানেল ব্যবহার করলেও বড় একটি অংশ টানেল দিয়ে চলাচল করে না, যা চট্টগ্রাম শহরের যানবাহনের আধিক্য বাড়িয়ে যানজটকে প্রকট করে তুলছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার যাত্রীদের শহরের অভ্যন্তরে পৌঁছানোর প্রয়োজনেও দূরপাল্লার যানবাহনগুলোর টানেলের ব্যবহার কম বলে জানিয়েছেন পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা।

সড়ক পরিবহনসংশ্লিষ্ট মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টানেলের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে কক্সবাজার যেতে পিএবি (পটিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালী) সড়ক ব্যবহার করলে দূরত্ব অন্তত ৩০-৩৫ কিলোমিটার কমে যায়। কিন্তু সড়কটি দুই লেনের হওয়ায় টানেল ব্যবহার করে কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে যেতে চায় না যানবাহন চালকরা। চট্টগ্রাম শহরের মধ্য দিয়ে কক্সবাজারে যাতায়াত অনেক বেশি লাভজনক মনে করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে খণ্ড খণ্ড আকারে গড়ে উঠেছে টার্মিনাল ও টিকিট বিক্রির কাউন্টারগুলো।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি  মো. মুসা  বলেন, ‘দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ কক্সবাজারমুখী যানবাহনগুলোর টানেল ব্যবহার একেবারে কম। প্রথম দিকে পর্যটকদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বাস টানেল ব্যবহার করলেও বর্তমানে সেটিও কমে গেছে। তাছাড়া সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা টানেল ব্যবহার করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের কাছাকাছি বিভিন্ন উপজেলায় রুট পারমিটের জন্য আবেদন করলেও সেটি এখনো পাওয়া যায়নি। যার কারণে সারা দেশের বিভিন্ন যানবাহন টানেল ব্যবহারের পরিবর্তে চট্টগ্রাম শহরকে বেছে নেয়।

বিবিএর তথ্য মতে, জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু টানেল থেকে সর্বমোট টোল আদায় হয়েছে ১২ কোটি ৪৯ লাখ। এর মধ্যে অক্টোবরের ৩ দিনে (২৯-৩১ অক্টোবর) আহরণ হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা, নভেম্বরে ৩ কোটি ৯৫ লাখ, ডিসেম্বরে ৪ কোটি ৮২ লাখ, জানুয়ারিতে ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৯৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। জুনের মধ্যে প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হবে। টানেলকে ঘিরে পুলিশ ক্যাম্প ও ফায়ার স্টেশন নির্মাণে সর্বশেষ ১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান সিডিডিএলের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

জানতে চাইলে যোগাযোগবিশেষজ্ঞ ও নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, ‘টানেল নির্মাণ শেষেও এখনো দক্ষিণ চট্টগ্রামকে ঘিরে শিল্পাঞ্চলসহ নানামুখী কর্মকাণ্ড শুরু হয়নি। টানেল পর্যন্ত যেতে এখন পর্যন্ত সেভাবে সংযোগ অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করতে পারেনি স্থানীয় সংস্থাগুলো। যার কারণে টানেলের ব্যবহার প্রাক্কলন অনুযায়ী হয়নি। স্থানীয় প্রশাসনের অদূরদর্শী চিন্তার ফলে টানেল এখনো উচ্চবিত্তের যাতায়াত মাধ্যম হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম বিশ্বের ১২তম ধীরগতির শহর হলেও গণপরিবহনের অভাব রয়েছে। টানেলের মতো বড় অবকাঠামো নির্মাণের পরও সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় আমরা এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।’

সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, প্রতিদিন ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সরাসরি দুটি ট্রেন চলাচল করে। প্রতিটি ট্রেনে ২০-২২টি যাত্রীবাহী কোচ সংযুক্ত থাকায় বাসের ওপর চাপ কিছুটা কমেছে। এসব বাসের মাত্র ১০ শতাংশেরও কম টানেল দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামে যায়। ফলে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চালু হওয়ার কারণেও টানেলের ওপর যানবাহনের চাপ কিছুটা কমছে বলে মনে করছেন পরিবহনসংশ্লিষ্টরা। বিশেষত পর্যটন মৌসুমে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে বাড়তি চাপের সময়ে কিছু দূরপাল্লার যানবাহন টানেল ব্যবহার করলেও ট্রেন সার্ভিসের কারণে সেটি কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক, উত্তর) জয়নুল আবেদিন বলেন, ‘‌টানেল দিয়ে এখনো ২০ শতাংশেরও কম দূরপাল্লার যানবাহন ব্যবহার করে। ফলে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার যানবাহন চট্টগ্রাম শহর ব্যবহার করেই দক্ষিণ চট্টগ্রামে যায়। টানেলকে ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানসহ বিভিন্ন জেলার যানবাহন চলাচলের জন্য টার্মিনাল নির্মাণ কিংবা রুট পারমিট প্রদানের কার্যক্রম শুরু হওয়ায় টানেল ব্যবহার করা যাচ্ছে না। যার কারণে টানেলের মতো অবকাঠামো নির্মাণ সত্ত্বেও¡চট্টগ্রাম শহরে যানজট বাড়ছে।’ এক্ষেত্রে বাড়তি টোলও টানেল ব্যবহার না করার জন্য অন্তরায় বলে মনে করেন তিনি।

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ব্যয় করছে ৪ হাজার ৬১৯ কোটি ৭০ লাখ ৬৬ হাজার টাকা এবং প্রকল্প সাহায্য থেকে ব্যয় হচ্ছে ৬ হাজার ৭০ কোটি ৬৭ হাজার টাকা। প্রকল্পটিতে বিনিয়োগ করেছে দি এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না।

টানেলের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংস্থাকে নিয়ে গঠিত কমিটি ২৮টি সুপারিশ করেছিল সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে। পাশাপাশি সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য ১১টি দাবি জানিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ট্রাফিক বিভাগ। কিন্তু টানেল চালুর পর এসব কার্যক্রম শুরু হয়, যা বাস্তবায়ন হতে আরো কয়েক বছর সময় লাগবে। এ কারণে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচলের হার আপাতত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়বে না বলেও মনে করছেন তারা।

নাগরিক প্রতিবেদন

২৭ মার্চ, ২০২৪,  12:16 PM

news image

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে যান চলাচল শুরু হয় গত বছরের ২৯ অক্টোবর। শুরুতে দৈনিক পাঁচ হাজারের অধিক গাড়ি চলাচল করত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচলের হার কমেছে। চলতি মার্চে টানেল দিয়ে পার হওয়া দৈনিক গাড়ির সংখ্যা নেমে এসেছে আড়াই হাজারের নিচে। এর উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রামজুড়ে। সম্প্রতি শহরে যানজট তীব্র হয়েছে। এর পেছনে টানেলের সংযোগ ও ব্যবস্থাপনার অভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) তথ্যে জানা গেছে, উদ্বোধনের পর প্রথম কয়েক মাস টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল ক্রমেই বাড়ছিল। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হলেও প্রতি মাসে টানেল দেখতে আসা পর্যটক, কক্সবাজারমুখী যানবাহনের চাপ বাড়তে থাকে। তবে চলতি মাসে টানেল ঘিরে যানবাহনের চাপ অস্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে গেছে। কক্সবাজারমুখী পর্যটকবাহী যানবাহনের চাপ না থাকায় টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল কমেছে বলে জানিয়েছে টানেল কর্তৃপক্ষ। তবে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় তীব্র যানজট তৈরি হয়েছে।

সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ফেব্রুয়ারিতে প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার ৯৪২টি করে যানবাহন টানেল ব্যবহার করেছে। তবে প্রথম থেকে ১২তম রমজানে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল করেছে গড়ে ২ হাজার ২৭৩টি। তার আগে গত বছরের অক্টোবরে যানবাহন চলাচলের গড় ছিল ৫ হাজার ৬৩৬টি, নভেম্বরে ৫ হাজার ৫৪৪, ডিসেম্বরে ৬ হাজার ২৭৩, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪ হাজার ৯০ এবং ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক যানবাহন চলাচলের গড় ছিল ৪ হাজার ৯৪২টি।

টানেল কর্তৃপক্ষ জানায়, টানেল দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের সিংহভাগ ছিল পর্যটক। টানেল দেখতে আসা বা পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে আসা মানুষ বিশেষ ব্যবস্থাপনায় যানবাহন নিয়ে টানেলে প্রবেশ করত। কিন্তু রোজার মাসে পর্যটকের আনাগোনা কমে যাওয়ায় টানেলে যানবাহনের সংখ্যা কমেছে। ঈদের পর থেকে যানবাহনের হার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে বলে আশা করছেন টানেল ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা।

বিবিএ সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের ফলে চট্টগ্রামের যানজট নিরসন ছাড়াও দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী যানবাহনের আধিক্য থাকবে বলে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা ছিল। বলা হয়েছিল উদ্বোধনের পর এ টানেল দিয়ে দৈনিক ১৭ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করবে। এছাড়া ২০২৮ সালে টানেল দিয়ে দৈনিক ২৮ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করবে। এ বিষয়ে বিবিএর দাবি, উভয় পাশে সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া টানেলের বহুমুখী ব্যবহার বাড়াতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থা নানামুখী অবকাঠামো নির্মাণ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। টানেল বাণিজ্যিকভাবে চালু হলেও এসব সংস্থার কাজ এখনো শুরু হয়নি।

জানতে চাইলে বিবিএর প্রধান প্রকৌশলী ও পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) কাজী মো. ফেরদাউস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌টানেল নির্মাণ প্রকল্পের সামগ্রিক ভৌতকাজ শেষ হয়েছে। এখন টানেলকে ঘিরে যানবাহন চলাচল উৎসাহিত করার কাজ স্থানীয় সরকারি সংস্থার। আমরা সংযোগ সড়ক নির্মাণ, টানেল ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছি। সিডিএ, সওজসহ বিভিন্ন সংস্থার নেয়া অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ হলে টানেলটি চট্টগ্রামের যানজট নিরসনসহ নানামুখী কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

অংশীজনরা জানান, চট্টগ্রামের যানজট নিরসনে অন্যতম অবকাঠামো হওয়ার কথা বঙ্গবন্ধু টানেল। চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ অংশের সাতটি উপজেলা, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার দূরপাল্লার যানবাহনগুলো চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ না করে টানেল দিয়ে পারাপার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে কক্সবাজারের পেকুয়া, চকরিয়া, কুতুবদিয়া ও মহেশখালীসহ কয়েকটি উপজেলার যানবাহন সীমিত পরিসরে টানেল ব্যবহার করলেও বড় একটি অংশ টানেল দিয়ে চলাচল করে না, যা চট্টগ্রাম শহরের যানবাহনের আধিক্য বাড়িয়ে যানজটকে প্রকট করে তুলছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার যাত্রীদের শহরের অভ্যন্তরে পৌঁছানোর প্রয়োজনেও দূরপাল্লার যানবাহনগুলোর টানেলের ব্যবহার কম বলে জানিয়েছেন পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা।

সড়ক পরিবহনসংশ্লিষ্ট মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টানেলের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে কক্সবাজার যেতে পিএবি (পটিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালী) সড়ক ব্যবহার করলে দূরত্ব অন্তত ৩০-৩৫ কিলোমিটার কমে যায়। কিন্তু সড়কটি দুই লেনের হওয়ায় টানেল ব্যবহার করে কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে যেতে চায় না যানবাহন চালকরা। চট্টগ্রাম শহরের মধ্য দিয়ে কক্সবাজারে যাতায়াত অনেক বেশি লাভজনক মনে করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে খণ্ড খণ্ড আকারে গড়ে উঠেছে টার্মিনাল ও টিকিট বিক্রির কাউন্টারগুলো।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি  মো. মুসা  বলেন, ‘দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ কক্সবাজারমুখী যানবাহনগুলোর টানেল ব্যবহার একেবারে কম। প্রথম দিকে পর্যটকদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বাস টানেল ব্যবহার করলেও বর্তমানে সেটিও কমে গেছে। তাছাড়া সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা টানেল ব্যবহার করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের কাছাকাছি বিভিন্ন উপজেলায় রুট পারমিটের জন্য আবেদন করলেও সেটি এখনো পাওয়া যায়নি। যার কারণে সারা দেশের বিভিন্ন যানবাহন টানেল ব্যবহারের পরিবর্তে চট্টগ্রাম শহরকে বেছে নেয়।

বিবিএর তথ্য মতে, জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু টানেল থেকে সর্বমোট টোল আদায় হয়েছে ১২ কোটি ৪৯ লাখ। এর মধ্যে অক্টোবরের ৩ দিনে (২৯-৩১ অক্টোবর) আহরণ হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা, নভেম্বরে ৩ কোটি ৯৫ লাখ, ডিসেম্বরে ৪ কোটি ৮২ লাখ, জানুয়ারিতে ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৯৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। জুনের মধ্যে প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হবে। টানেলকে ঘিরে পুলিশ ক্যাম্প ও ফায়ার স্টেশন নির্মাণে সর্বশেষ ১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান সিডিডিএলের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

জানতে চাইলে যোগাযোগবিশেষজ্ঞ ও নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, ‘টানেল নির্মাণ শেষেও এখনো দক্ষিণ চট্টগ্রামকে ঘিরে শিল্পাঞ্চলসহ নানামুখী কর্মকাণ্ড শুরু হয়নি। টানেল পর্যন্ত যেতে এখন পর্যন্ত সেভাবে সংযোগ অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করতে পারেনি স্থানীয় সংস্থাগুলো। যার কারণে টানেলের ব্যবহার প্রাক্কলন অনুযায়ী হয়নি। স্থানীয় প্রশাসনের অদূরদর্শী চিন্তার ফলে টানেল এখনো উচ্চবিত্তের যাতায়াত মাধ্যম হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম বিশ্বের ১২তম ধীরগতির শহর হলেও গণপরিবহনের অভাব রয়েছে। টানেলের মতো বড় অবকাঠামো নির্মাণের পরও সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় আমরা এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।’

সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, প্রতিদিন ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সরাসরি দুটি ট্রেন চলাচল করে। প্রতিটি ট্রেনে ২০-২২টি যাত্রীবাহী কোচ সংযুক্ত থাকায় বাসের ওপর চাপ কিছুটা কমেছে। এসব বাসের মাত্র ১০ শতাংশেরও কম টানেল দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামে যায়। ফলে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চালু হওয়ার কারণেও টানেলের ওপর যানবাহনের চাপ কিছুটা কমছে বলে মনে করছেন পরিবহনসংশ্লিষ্টরা। বিশেষত পর্যটন মৌসুমে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে বাড়তি চাপের সময়ে কিছু দূরপাল্লার যানবাহন টানেল ব্যবহার করলেও ট্রেন সার্ভিসের কারণে সেটি কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক, উত্তর) জয়নুল আবেদিন বলেন, ‘‌টানেল দিয়ে এখনো ২০ শতাংশেরও কম দূরপাল্লার যানবাহন ব্যবহার করে। ফলে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার যানবাহন চট্টগ্রাম শহর ব্যবহার করেই দক্ষিণ চট্টগ্রামে যায়। টানেলকে ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানসহ বিভিন্ন জেলার যানবাহন চলাচলের জন্য টার্মিনাল নির্মাণ কিংবা রুট পারমিট প্রদানের কার্যক্রম শুরু হওয়ায় টানেল ব্যবহার করা যাচ্ছে না। যার কারণে টানেলের মতো অবকাঠামো নির্মাণ সত্ত্বেও¡চট্টগ্রাম শহরে যানজট বাড়ছে।’ এক্ষেত্রে বাড়তি টোলও টানেল ব্যবহার না করার জন্য অন্তরায় বলে মনে করেন তিনি।

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ব্যয় করছে ৪ হাজার ৬১৯ কোটি ৭০ লাখ ৬৬ হাজার টাকা এবং প্রকল্প সাহায্য থেকে ব্যয় হচ্ছে ৬ হাজার ৭০ কোটি ৬৭ হাজার টাকা। প্রকল্পটিতে বিনিয়োগ করেছে দি এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না।

টানেলের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংস্থাকে নিয়ে গঠিত কমিটি ২৮টি সুপারিশ করেছিল সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে। পাশাপাশি সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য ১১টি দাবি জানিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ট্রাফিক বিভাগ। কিন্তু টানেল চালুর পর এসব কার্যক্রম শুরু হয়, যা বাস্তবায়ন হতে আরো কয়েক বছর সময় লাগবে। এ কারণে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচলের হার আপাতত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়বে না বলেও মনে করছেন তারা।